সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধি এবং এর প্রতিকার

তানভীর হোসাইন:

আমরা চাইলেই কি একা বসবাস করতে পারি? পারিনা, তাই না? এর মৌলিক কারণ হলো আমরা সৃষ্টিগতভাবে সামাজিক। তাই সমাজের অংশ হিসেবেই আমাদের  বসবাস করতে হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষের বসবাস রয়েছে, যারা সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে চাইলেও বস্তুত একধরনের ভীতির কারনে একাকিত্বে সময় কাটান। কিন্তু এই একাকিত্বে তারা খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন বা তাদের কাছে ভালো লাগে বিষয়টি তেমনও নয়। মূলত এসকল মানুষগুলো সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধিতে আক্রান্ত যা তাদেরকে গুনে ধরা কাঠের মত ভঙ্গুর করে দিনের পর দিন। বাহির থেকে জীবিত মনে হলেও ভিতর থেকে আসলে মৃত।

সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধি সামাজিক ফোবিয়া হিসেবেও পরিচিত।  এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা অন্য মানুষের সাথে কথা বলতে, নতুন মানুষের সাথে মিশতে এবং সামাজিক অনুষ্ঠান গুলোতে যোগ দিতে স্বভাবত পিছুটান দেখা যায়। আবার একইসাথে অপরজনের সমালোচনামূলক মন্তব্যকে প্রচন্ডরকম ভয় পান। যদিও তারা বুঝতে পারে তাদের এই ভয় আসলেই অযৌক্তিক তবুও তারা এই সমস্যাকে কাটিয়ে উঠতে ভিতর থেকে শক্তি সঞ্চার করতে পারেনা।

তবে সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধিকে লাজুকতার সাথে মিশিয়ে ফেলা যাবেনা। অনেকেই ভাবে, লজ্জাবোধই ‘সোশ্যাল ফোবিয়ার’ কিংবা ‘সমাজভীতি’র একমাত্র লক্ষণ। বস্তুত এটি স্বভাবসুলভ লজুক ভাব থেকে কিছুটা ভিন্ন। লজুক ভাব সাধারণত সল্পমেয়াদী হয় যার ফলে স্বাভাবিক জীবনে এর প্রভাব তেমন উপলব্ধি করা যায়না। তবে সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধিটি ধীর্ঘমেয়াদী হয় এবং মানুষকে ভিতর থেকে উই পৌকার মত খেয়ে ফেলে। যা মানুষের বিভিন্ন স্বাভাবিক কাজে প্রভাব ফেলে। যেমন ধরুন- দৈনন্দিন কাজে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনায়, পরিবারের বহিরে অন্য মানুষদের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।

এনেক্সাইটি এন্ড ডিপ্রেশন এসোসিয়েশন অব আমেরিকার (ADAA) এক জরিপে দেখা যায়, আমেরিকায় সর্বমোট ১৫ মিলিয়ন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মাঝে সোসাল এনেক্সাইটি ডিসঅর্ডার বা সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধি রয়েছে। তাদের এই সমস্যার লক্ষ্মণ ১৩ বছর বয়স থেকেই দেখা যায়।

সোসাল এনেক্সিটি ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের কিছু শারিরীক লক্ষ্মণ দেখতে পাওয়া যায়। সেগুলো হলো-

  • অধিক লাজুকতা,
  • বমি বমি ভাব
  • অতিমাত্রায় ঘামানো
  • শরীরে কাঁপুনি
  • মাথা ঘোরা বা  হালকা মাথা ব্যথা
  • কথা বলতে অসুবিধা
  • ঘন ঘন নিঃশ্বাস নেওয়া

শারীরিক লক্ষ্মণের বাহিরেও কিছু মানসিক লক্ষ্মণ রয়েছে। যেমন-

  • সমাজিক বিষয় নিয়ে তীব্রভাবে দুশ্চিন্তা করা
  • কোন অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়াকে কেন্দ্র করে কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ পূর্বে থেকে দুশ্চিন্তা করা
  • সামাজিক অনুষ্ঠান গুলোতে অংশগ্রহণ এড়িয়ে চলা
  • যদি কোন কারণে অবশ্যই উপস্থিত হতে হয় তখন সেখানে বিচ্ছিন্ন ভাবে সময় কাটানো
  • একটি সামাজিক অনুষ্ঠানের উপস্থিতির বিব্রত অবস্থা কেউ লক্ষ্য করছে কিনা সেটা নিয়েও উদ্বিগ্ন থাকা

নতুন কোন পরিবেশে গেলে মাঝে মাঝে উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক বিষয়। তবে সেটা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয় তখন সামাজিক ফোবিয়া হিসেবে ধরা হয়। সামাজিক ফোবিয়ায় আক্রান্ত ব্যাক্তিরা অন্যদের দ্বারা বিচার হওয়া বা তাদের সামনে বিব্রত হওয়ার ভয় পেতে থাকেন, ক্রমাগতভাবে মনের মধ্যে উঁকি দেয় তখন তারা সামাজিক কিছু বিষয়গুলোকে এড়িয়ে চলতে চায়। যেমন- কোন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা যেমন,

  • কি করেন
  • কেমন আছেন বা পরিচিত হওয়া
  • অন্যের বর্তমান অবস্থা বা চাকুরী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা
  • পাবলিক বিশ্রামকক্ষ ব্যবহারে বিব্রত হওয়া
  • ফোনে কথা বলা
  • জনসমক্ষে খাওয়াসহ বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে ভীতি।

অর্থাৎ সবসময় খুঁতখুঁতে স্বভাবের হওয়া। অন্যের সামনে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করা।

তবে সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধির উপসর্গ সব পরিস্থিতিতে নাও ঘটতে পারে। হতে পারে আপনি নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রেই এই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, যখন আপনি লোকেদের সামনে খাবার গ্রহণ করছেন কিংবা অপরিচিতদের সাথে কথা বলছেন, শুধু তখনই আপনি অস্বস্তিতে ভুগছেন। আপনার যদি অতিমাত্রায় এই উদ্বিগ্ন ব্যাধিটি থেকে থাকে তবে সব ধরণের সামাজিক কাজগুলোতেই লক্ষণগুলি দেখা দিতে পারে।

সামাজিক ফোবিয়ার সঠিক কারণ সকলের কাছে অজানা। তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন এটি পরিবেশ ও জেনেটিক উভয় কারণে হতে পারে। পরিবেশগত কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • বুলিং এর স্বীকার
  • পারিবারিক দ্বন্দ্ব
  • যৌন নির্যাতনের স্বীকার
  • মানসিক নির্যাতনের স্বীকার ইত্যাদি।

সেরোটোনিন (Serotonin) নামক রোগের ভারসাম্যহীনতাও সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হওয়ায় অবদান রাখতে পারে। সেরোটোনিন মস্তিষ্কের একটি ক্যামিকেল যা মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। তাছাড়া অত্যধিক অ্যামিগডালাও (মস্তিষ্কের একটি কাঠামো যা ভয়ের প্রতিক্রিয়া, অনুভূতি বা চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করে) এই ব্যাধির কারণ হতে পারে।

পরিবারের মধ্যেও জেনেটিক ভাবে এই উদ্বেগজনিত ব্যাধি চলে আসতে পারে। গবেষকরা যদিও সম্পূর্ণ নিশ্চিত নন যে জেনেটিক কারণেই এই ব্যাধিটি ঘটতে পারে।

সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধি নির্ণয় করার উপায়:

সামাজিক উদ্বেগজনিত ব্যাধি নির্ণয়ে উখনও নির্দিষ্ট কোন মেডিকেল পরীক্ষা যদিও নেই। তবুও আপনার স্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসক সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধির লক্ষণগুলির বর্ণণা শুনে আপনার  সামাজিক ফোবিয়া নির্ণয় করতে পারেন।

চিকিৎসকের সাথে সাক্ষাতের সময় আপনার সমস্যাগুলো ব্যাখ্যা করতে বলবেন। বিশ্লেষকদের মতে সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধির মানদণ্ডের মধ্যে রয়েছে-

  • অন্যের দ্বারা জাজ হওয়ার ভয়ে সামাজিক কাজগুলো থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখা
  • একটি সামাজিক আচার অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের আগে উদ্বিগ্ন বা আতঙ্কিত বোধ করা
  • এই উপলব্ধির তৈরি হওয়া যে, আপনার ভয় পাওয়াটা অযৌক্তিক তবুও সেখান থেকে উত্তরিত হতে না পেরে উদ্বিগ্নতা আপনার দৈনন্দিন জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করেছে কিনা
সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধির চিকিৎসা:
সামাজিক উদ্বেগজনিত ব্যাধি যেমন ব্যাক্তি ভেদে ভিন্ন তেমনি এর চিকিৎসাও ভিন্ন হয়। কখনও প্রাথমিক যত্ন প্রদানকারীরা উপসর্গের চিকিৎসার জন্য ওষুধের পরামর্শ দিতে পারেন।

সামাজিক উদ্বেগজনিত ব্যাধির চিকিৎসা সরূপ বিকল্পগুলির মধ্যে রয়েছে-

জ্ঞানীয় সম্বন্ধীয় আচরণগত থেরাপিঃ
এই থেরাপি আপনাকে কীভাবে বিশ্রাম ও অধিক শ্বাস-প্রশ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে উদ্বেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় এবং নেতিবাচক চিন্তাভাবনাগুলিকে কিভাবে ইতিবাচকতায় রূপ দেওয়া যায় সে বিষয়ে কাজ করে।

এক্সপোজার থেরাপিঃ
এই ধরনের থেরাপি আপনাকে শিক্ষা দিবে কিভাবে সামাজিক বিষয়গুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার পরিবর্তে সেগুলোকে মেকাবেলা করে আপনার ভয়কে কাটিয়ে উঠা যায়।

এছাড়াও দৈনন্দিন কিছু খাবার নিয়ন্ত্রণ করেও সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়। যেমন-

  • ক্যাফেইন জাতীয় খাদ্য এড়িয়ে চলা
  • কফি, চকলেট, সোডা, ফাস্টফুড জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা
  • অধিক খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা

পর্যাপ্ত ঘুমানো মাধ্যমেও এই ব্যাধিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।চিকিৎসকদের মতে রাতে ৬ থেকে ৮ ঘন্টা ঘুমানো। এতে আপনার মানসিক দুশ্চিন্তা নিয়ন্ত্রণে থাকবে। আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসক আপনাকে কিছু ঔষধের পরামর্শ দিতে পারেন যা আপনার উদ্বেগ ও বিষন্নতা বৃদ্ধি করতে পারে যদি সেটি আপনার জীবন ধারায় উন্নতি ঘটাতে ব্যহত হয়।

সামাজিক উদ্বেগজনিত ব্যাধির চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) কতৃক অনুমোদিত ঔষধ গুলোর মধ্যে রয়েছে-

  • প্যাক্সিল (Paxil)
  • (Zoloft)
  • জোলফ্ট এবং
  • ইফেক্সর এক্সআর ( Effexor XR)

আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসক প্রথমে ওষুধের মাত্রা কমিয়ে দিয়ে তারপর সময়ের সাথে তা বৃদ্ধি করতে পারে। এই ঔষধ গুলোর সাধারণ পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে রয়েছে:

  • নিদ্রাহীনতা
  • ওজন বৃদ্ধি পাওয়া
  • পেট খারাপ হওয়া
  • যৌন চাহিদা কমে যাওয়া

কোন ধরনের চিকিৎসা আপনার জন্য সঠিক তা সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা এবং ঝুঁকি সম্পর্কে আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন।

সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধির বাহৃিক রূপ

ADAA এর মতে, ৩৬ শতাংশ লোক যারা ১০ বছর সামাজিক উদ্বেগ ব্যাধিতে আক্রান্ত থাকার পর চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করে।

এই রোগে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা সামাজিক উদ্বেগকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য মাদক, মদ, সিগারেট সহ নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করে। এছাড়াও এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যাক্তিরা নানা রকম ঝুকিপূর্ণ কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে যার মধ্যে অন্যতম হলো অ্যালকোহল এবং মাদক সেবন। মাদকাসক্ত এসকল রোগীরা আবার একাকীত্ব, আত্মহত্যার চিন্তা, ক্রোধান্বত মনোভাবের মধ্যে নিজেদের জড়িয়ে নিতে পারেন।

পরিশেষে আপনার ভয়কে নিয়ন্ত্রণে রাখুন। আপনাকে নার্ভাস বা উদ্বিগ্ন করে তোলে এমন উৎসগুলোকে খুঁজে বের করুন সেই সাথে আপনার চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ রাখুন ও পরামর্শ নিন। এতে আপনি সমস্যা থেকে উত্তরিত হবেন আশা করা যায়।

তথ্যসূত্র: আমেরিকান সাইকিয়াট্রিক এসোসিয়েশন, হেল্থলাইন ডট কম।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version