গনরুমে যাপিত জীবনের গল্প

হাসান আল মাহমুদ:

ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা বেজে ৩০ মিনিট। হলের ২০৫ নাম্বার রুম, হাল্কা বাতাসে ভেসে আসছে গানের ধ্বনি, একজনের কণ্ঠে নয়, ১০ থেকে ১২ জনের মিলিত কণ্ঠ থেকে ভেসে আসছে বেসুরো গলার সুর। কখনো ‘কফি হাউজের সেই আড্ডাটা’, কখনওবা ‘এমন যদি হতো আমি পাখির মত’।

বলছিলাম একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের গনরুম, গেস্টরুমের কথা। যদিও গেস্টরুম’ বললে সাধারণ মানুষ ভাবতে পারেন, এখানে বাইরের লোকজন এলে চা-নাশতা খাওয়ানো হয়। তাই গনরুমের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগে ছোট পরিসরে এর একটি সংজ্ঞা প্রদান করা উচিত।

আদতে এই ‘গেস্টরুম’ হলো প্রভাবশালী সিনিয়রদের নির্ধারিত আচরণ শেখানো এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নের নির্ভরযোগ্য আবাসস্থল। তবে সাধারণত হলের অতিথিকক্ষে এসকল কর্মযজ্ঞে ঘটে বলে এটিকে ‘গেস্টরুম’ নামে পরিচয় করানো হয়। আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপটে গনরুম হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে আসনসংখ্যার তুলনায় বেশি শিক্ষার্থীদের গাদাগাদি করে থাকার জায়গা। সাধারণত ৪ কিংবা ৫ জন শিক্ষার্থী বসবাসের উপযোগী এইসব রুমগুলোতে গাদাগাদি করে প্রথম বর্ষের ১৫ জন ২০ জন কিংবা কখনও ৩০ থেকে ৪০ জন শিক্ষার্থী দিনযাপন করে থাকে।

বাহিরের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গনরুম সংস্কৃতি কিংবা গনরুম শব্দটির কোন অস্তিত্ব পাওয়া না গেলেও আমাদের দেশীয় প্রেক্ষাপট বিবেচনায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীরা এ সংস্কৃতির সাথে বেশ পরিচিত।

আবার এসকল শিক্ষার্থীদের একেক জনের কাছে গনরুমের সংজ্ঞাও একেক রকম। কারও কাছে গনরুম মানে হচ্ছে পারিবারিক অস্বচ্ছলতার কারনে পকেট খরচ কমানোর একটি উপায়মাত্র। আবার কারও কাছে বাসস্থানের সংকট কাটাতে এটি একটি আশ্রয়স্থল।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে চান্স পাওয়া অধিকাংশ শিক্ষার্থীরাই অসম্ভব রকমের মেধাবী অথচ পারিবারিক ভাবে অস্বচ্ছল কিংবা নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি আসনের নিশ্চিত করবার জন্য তাদেরকে ৫০ থেকে ৬০ জন শিক্ষার্থীর সাথে রিতীমত যুদ্ধ করে আসতে হয়। কিন্তু বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই দারিদ্র্যের কষাঘাতে অদম্য মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও থাকার জায়গা হয় গনরুমের মতো ঘিঞ্জি পরিবেশে।

ফলে এইসকল মেধাবী শিক্ষার্থীরা মেধার বিকাশ ঘটানোর আগেই প্রতিকূল পরিবেশে লক্ষ্যে পৌছুতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হন। কারন অধিকাংশ গনরুমগুলোতেই পড়াশোনার জন্য প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র কিংবা সুস্থ পরিবেশ থাকে না। কেবল মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে শিক্ষার্থীরা এ পরিবেশকে মন্দের ভালো হিসেবে বেছে নেয়। আবার আবাসিক হল গুলোতে পর্যাপ্ত রিডিং রুমের অভাবে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ব্যাহত হয়।

এখানেই শেষ নয়, অধিকাংশ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সক্রিয় কার্যক্রম থাকে। সেখানে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন নেতাকর্মীরা হলের সিট নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে একজন শিক্ষার্থী যতই মেধাবী হোননা কেন সেক্ষেত্রে হলের সিট পেতে হলে অবশ্যই বিশেষ নেতার মন যুগিয়ে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।

বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এমন সংস্কৃতির প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ-শিক্ষকসমাজ-সাংস্কৃতিক-সাংস্কৃতিক কর্মীদের ত্রিমুখী সমালোচনা এবং প্রতিবাদের মুখেও সেটির তেমন পরিবর্তন দেখা যায় না। এমনকি নেতাদের মন যোগাতে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের সপ্তাহে তিন-চার দিন গেস্টরুমের বিভীষিকাময় সময় পার করতে হয়।

প্রথম বর্ষের এসকল শিক্ষার্থীরা ২ থেকে ৩ মাসের মধ্যে হলের সিট পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে গনরুমে উঠলেও বাস্তবে সে অনুযায়ী সিটের দেখা মেলেনা। এই করুণ পরিনতির আরেকটি কারন হল, প্রতিবছরই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী বৃদ্ধির হারের সাথে তাদের জন্য মানসম্মত আবাসন নির্মাণ হয় না। আবার অনেক সিনিয়রদের শিক্ষার্থী স্নাতকোত্তর শেষ হয়ে গেলেও চাকরির প্রস্তুতি নেয়া বা সেশনজটের কারণে হলে অবস্থান করেন। এতে সুষ্ঠু তদারকির অভাবে সমস্যা নিরসন সম্ভব হয়না।

তবুও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগকে শিক্ষার্থীরা আশীর্বাদ হিসেবে নেন। তবে এমন আশীর্বাদের গনরুম একটি ‘সার্ভাইভাল অফ দ্যা ফিটেস্ট’ উক্তিটির মত হলেও এই সার্ভাইভাল চ্যালেঞ্জ  নামে ভয়ঙ্কর পরীক্ষায় সবাই সার্ভাইভ করে উঠতে পারে না। গনরুমে র‍্যাগিং এর কবলে পড়ে জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়ার ঘটনা নেহাত কমও নয়। অসম্ভব মেধাবী এবং অপার সম্ভাবনাময় হওয়া সত্ত্বেও অনেক শিক্ষার্থীই হারিয়ে যায় গনরুম নামক গোলক ধাঁধায়।

তাই এই গনরুম ও র‍্যাগিং এবং সকল অনিয়ম থেকে বের হয়ে আসার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ এবং দায়ত্বশীলদের সচেতন মনোভাব অত্যান্ত জরুরি।  তাছাড়া আমাদের সবার দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব না।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version