বর্তমান তথ্য প্রযুক্তি ও আমাদের তরুণ প্রজন্ম

মোঃ হাছান:

তথ্য প্রযুক্তি আর্শীবাদ নাকি অভিশাপ এই বিতর্ক বহু দিনের। কারও মতে তথ্য প্রযুক্তি জীবনকে সহজ করে দিয়েছে। আবার কারও অভিব্যাক্তি অনুযায়ী এটি জীবনকে জটিল করে দিয়েছে। বস্তুত সেটি নির্ভর করে ব্যবহারকারীর উপর। একজন ব্যবহারকারী মাধ্যমটিকে আর্শীবাদ হিসেবে নিয়েছে নাকি নিজেকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে, আনুষাঙ্গিক কার্যক্রমের উপরে ভিত্তি করে সেটি নির্ণীত হতে পারে।

তবে প্রযুক্তির অনবদ্য এই জগতের যারা ধারক বাহক এর ভয়াবহ পরিনতি সম্পর্কে তারা বিস্তর সচেতন। ২০১১ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্টিভ জবস বলেছিলেন, “তাঁর সন্তানদের জন্য আইপ্যাড ব্যবহার একেবারেই নিষিদ্ধ”। আইফোনে আসক্ত তরুণ এ প্রজন্মকে বলা হচ্ছে ‘আইজেন’ (১৯৯৫ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্য যাদের জন্ম, তাদের ‘আইজেন’ বলা যায়)। দ্য আটলান্টিকের এক প্রতিবেদনে এ প্রজন্মের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর স্মার্টফোনের প্রভাবের বিষয়টি উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, এখনকার কিশোরেরা বন্ধুর সান্নিধ্যে কম সময় কাটায়, তাদের মধ্যে ডেটিং কমছে, এমনকি পুরো প্রজন্মের ঘুম কম হচ্ছে। একাকিত্বের এই হার বাড়ায় সাইবার নিপীড়ন, হতাশা, উদ্বেগ এবং একইসাথে আত্মহত্যার মত ঘটনা বাড়ছে।

‘হ্যাভ স্মার্টফোনস ডেস্ট্রয়েড আ জেনারেশন’ শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে আইজেন প্রজন্মের খুঁটিনাটি তুলে ধরেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিদ্যার অধ্যাপক জিন টুয়েঙ্গে।

তবে আমাদের জতীয় এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি গুরুতর। উদ্বেগের বিষয় হল আমাদের সমাজে তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির এই সহজলভ্যতাকে খুব স্বল্প পরিমানে কাজে লাগিয়েছে। ফলে এক বিশাল হতাশাগ্রস্ত প্রজন্ম আমাদের সাথে রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে সেটি দেখা যায়। তাদের এই হতাশার পেছনে প্রযুক্তির নিবীড় সম্পর্ক রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের অভিমত। অর্থাৎ আমাদের তরুণ প্রজন্ম দিন দিন গহীন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে হারিয়ে যেতে থাকলে পৃথিবী জুড়ে নেমে আসবে ঘোর অন্ধকার। যে অন্ধকারে ডুবে যাবে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ। এমনকি তারা এই সবুজ সৌন্দর্য ঘেরা পৃথিবীর দিকে চেয়ে প্রশান্তি অনুভব করবার অনুভূতিও হারিয়ে ফেলবে।

আরও দুঃখের বিষয় হলো আগামী প্রজন্মের জন্য হয়ত এই রকম পৃথিবী অপেক্ষা করছে, যেখানে সমস্ত সম্পর্ক প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে। সমস্ত অনুভূতি ভার্চুয়াল হয়ে যাবে। কারণ বর্তমানে পৃথিবীর ৪২ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহারের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। ধারণা করা হয় এই হার বৃদ্ধি পেয়ে ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ পৃথিবীর প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষকে ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আসবে।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসির) হিসাব অনুযায়ী গত ৫ বছর আগে বাংলাদেশে ২০১৫ সালের আগস্টে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় চার কোটি আট লাখ। ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় তিন কোটি। প্রতি ১২ সেকেন্ডে একটি করে ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে যেটা বাংলাদেশের জন্মহারের চেয়েও বেশি।বর্তমানে এর সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।

তাই আমাদের তরুন প্রজন্ম যে হারে ইন্টারনেটের প্রতি ঝুঁকছে, এটা নিশ্চয়ই আগামী প্রজন্মের জন্য উদ্বেগজনক। কারণ বাংলাদেশের সচেতন কিংবা অসচেতন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের শতকরা তিরানব্বই ভাগের বয়সই হচ্ছে ১৮ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে।

গবেষকদের তথ্যমতে, ঘুমের আগে মোবাইলের ‘ডিসপ্লের আলোক রশ্মি’ ঘুমের হরমোনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করে থাকে৷ তাই গবেষকদের পরামর্শ হলো, ঘুমের আগে যতদূর সম্ভব প্রযুক্তির সংস্পর্শে না আসা।

এছাড়াও অনিয়ন্ত্রিত ইন্টারনেট আসক্তির ফলে বাড়ছে নানা জটিলতা। আমাদের সমাজের উঠতি বয়সী তরুণ তরুণীদের অতিমাত্রায় ইন্টারনেট আসক্তির ফলে যেসকল গুরুতর বিকৃতি এবং সমস্যা দৃশ্যমান হচ্ছে তারমধ্যে, অসামজিকতা, মানসিক বৈকল্য, বেকারত্ব, কু-সামাজিকীকরণ, এটিকে ফ্যাশন হিসেবে নেওয়া, সুষ্ঠু বিনোদনের অভাব, শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, সুষ্ঠু সাংস্কৃতিক চর্চার অভাব, শারীরিক চর্চা ও খেলাধুলার প্রতি অনীহা, যৌথ পরিবারের বিলুপ্তি, নিঃসঙ্গতা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, বিচারহীনতা ইত্যাদি অন্যতম।

এছাড়া ইন্টারনেটে অনিয়ন্ত্রিত অপরাধ প্রবণতার কারনে বাড়ছে সাইবার অপরাধ, হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ চুরি, এবং ক্রমবর্ধমান পর্ণ আসক্তি।

সুতরাং এটা বলা যায় যে একজন মানুষ ইন্টারনেট জগতে শুধুমাত্র ব্যাবহারে দক্ষ হলেই মহাপুরুষ হয়ে যায়না বরং দেশ ও জাতির কল্যাণে তার ব্যবহার নিশ্চিত করে মানবিক মূল্যবোধ বজায় রাখতে পারলেই মহাপুরুষ হওয়া যায়। তাই এই ইন্টারনেট আসক্তির মত করুন পরিনতি থেকে উত্তরণে রাষ্ট্রীয় ও পারিবারিক নজরদারি নিশ্চিত করতে হবে।

ব্যক্তি পর্যায়েও নৈতিকতা বজায় রাখতে হবে। ব্যক্তি ও পারিবারিক সচেতনতার মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। শিশুদের সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশের সুযোগ তৈরী করে দিতে হবে। পর্যাপ্ত খেলাধুলা পার্ক বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা ইন্টারনেট আসক্তি থেকে বের হয়ে সুস্থ সংস্কৃতি বিকাশের চর্চা করতে পারে। নৈতিক মূল্যবোধ তৈরী ও ইন্টারনেট আসক্তি নিরসনে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করার মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।

আমাদের জেনে রাখা দরকার যে, বর্তমানে দেশে ৯ কোটির বেশি ইন্টারনেট সংযোগ সচল রয়েছে। বর্তমান সরকারের তথ্য যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের হিসাবে ফেসবুক ব্যবহার করছে প্রায় ৩ কোটি। বর্তমানে দেশে প্রায় ৩ কোটি ২০ লক্ষ তরুণ৷ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ হতে গেলে এই বিশাল তরুণ প্রজন্মকে কর্মে নিয়োজিত করতেই হবে৷ ভবিষ্যতে তাঁরা কী ধরণের কর্মে নিয়োজিত হবেন, তরুণদের জন্য কী সুযোগ আছে এবং দলগুলো কী ধরনের সুযোগ সৃষ্টি করবে এটাই এখন চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত সচেতন নাগরিক ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের। তবেই যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির মাধ্যমে আমাদের দেশ ও সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -

1 COMMENT

  1. বাস্তবসম্মত লেখা।কৃত্রিমতা ছেড়ে আমরা যত সবুজে ফিরে যাবো আমাদের জন্য ততই ভাল হবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version