অনুবাদ: জুবায়ের রহমান
টানা সপ্তমবারের মতো বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় রয়েছে ফিনল্যান্ড। এই র্যাংকটি করা হয়েছে ১০টি সূচকের মাধ্যমে। যেখানে ০ থেকে ১০ পর্যন্ত সূচক দেখানো হয়েছে। যা প্রত্যকটি দেশের কয়েক হাজার মানুষকে এই সূচকের আলোকে জিজ্ঞাসা করা হয়। সেই জিগাসার উপর ভিত্তি করেই নির্ধারণ করা হয় সুখী দেশের তালিকা। কিন্তু আমাদের পরীক্ষামূলক গবেষণার ফলাফল বলছে এই সূচকটি মানুষকে তার ক্ষমতা এবং সম্পদ এর উপর ভিত্তি করেই করা হয়ে থাকে।
২০০৫ সাল থেকে জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় গ্যালাপ জরিপের মাধ্যমে এই সুখ পরিমাপ করার কাজটি করে আসছে। এই কাজটির বিশেষ গুরুত্ব হচ্ছে যে একটি দেশের সরকার তার দেশের জনগণের মঙ্গলের জন্য কাজ করছে বা ভালো কাজকে গুরুত্ব দিচ্ছে সেটিকেই নির্দেশ করে।
উদাহরণস্বরূপ যুক্তরাজ্য সহ ‘অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন সংস্থা’ ভুক্ত দেশসমূহ এখন তাদের জনগণের সুখ পরিমাপ করে থাকে। এক দশকেরও বেশি আগে ভুটান সরকার ঘোষণা করেছিল যে তাদের সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য হল “মোট জাতীয় সুখ”প্রাধান্য দিবে, মোট দেশীয় পণ্য নয়।
বিশ্বে সুখী দেশের তালিকা করা হয়েছে সহজ ১০টি সূচকের উপর ভিত্তি করে, যেখানে গ্যালপ মানুষের জীবন মূল্যায়নকারী হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকে।
“অনুগ্রহ করে একটি সূচক কল্পনা করুন যার ধাপগুলি শূন্য থেকে শীর্ষে দশ পর্যন্ত। সিঁড়ির উপরের অংশটি আপনার জন্য সর্বোত্তম সম্ভাব্য জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং সিঁড়ির নীচের অংশটি আপনার জন্য সবচেয়ে খারাপ সম্ভাব্য জীবনকে উপস্থাপন করে। সূচকের কোন ধাপে আপনি বলবেন যে আপনি ব্যক্তিগতভাবে এই সময়ে দাঁড়িয়ে আছেন বলে মনে করেন?”
আপনি প্রশ্নটি পড়ার সাথে সাথে, সূচকের শীর্ষ এ বিষয়টি আপনাকে কী ভাবতে বাধ্য করে এবং এটি আপনাকে কী বোঝায়? এটা কি ভালবাসা, টাকা, আপনার পরিবার- নাকি অন্য কিছু?
আমি সম্প্রতি সুইডেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের একদল গবেষক নিয়ে কাজ করেছি। যেখানে যুক্তরাজ্যের ১৬০০ জন প্রাপ্তবয়স্কদের উপর গবেষণা করেছি। গবেষণার আলোকে ন্যাচার সাইন্টিফিক রিপোর্টস জার্নালে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেছি। সেখানে আমরা পাঁচটি স্বতন্ত্র গোষ্ঠীর উপর এই পরীক্ষা চালিয়েছি।
একটি দলকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে যেখানে সূচকের শীর্ষটি তাদের প্রতিনিধিত্ব করে। অন্য একটি দলকে ঠিক একই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, কিন্তু এবার ০ থেকে ১০ এর সূচকের পরিবর্তে স্ক্রেল ব্যবহার করা হয়েছে।
আমাদের সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ০ থেকে ১০ এর যে সূচকে সুখ পরিমাপ করা সেখানে মানুষের ক্ষমতা ও সম্পদ সম্পর্কে বেশি ভেবে থাকে। অন্যদিকে পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তাদের তেমন কোনো ভাবনা নেই। যখন এই সূচকটি র পরিবর্তে স্ক্রেল ব্যবহার করা হয়েছে তখনে দেখা গেছে যে অর্থ-সম্পদের কথা বেশি ভেবেছিল।
এবার যখন তৃতীয় গোষ্ঠীতে আমরা কাজ করি, তখন ১০ টি সূচকের প্রশ্নের উলটপালট করে দেওয়া হয়। চতুর্থ এবং পঞ্চম গোষ্ঠীতে উপরের পরিবর্তনগুলো ছাড়াও “সর্বোত্তম সম্ভাব্য জীবন” বাক্যাংশটিকে যথাক্রমে “সুখী সম্ভাব্য জীবন” এবং “সবচেয়ে সুরেলা জীবন” দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয়েছিল।
সুখ ও সম্প্রীতি গোষ্ঠীর লোকেরা অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় ক্ষমতা এবং সম্পদ সম্পর্কে কম গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। অন্যদিকে তারা বৃহত্তর কল্যাণ; যেমন সম্পর্ক, কর্ম-জীবনের ভারসাম্য এবং মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্ক নিয়ে বেশি চিন্তা করে থাকে।
মানুষ সূচকের শীর্ষে যেতে চায় না
আমার গবেষণা দলের সদস্যরা মানুষকে জিজ্ঞাসা করেছিল যে তারা বিভিন্ন প্রশ্নের (সূচকের) স্কেলে কোথায় থাকতে চায়। গবেষকরা প্রায়শই অনুমান করেন যে সবসময়ই মানুষ সর্বোত্তম সম্ভাব্য জীবন চায়। কিন্তু, আমাদের জানা মতে, কেউ এটি পরীক্ষা করে দেখে না। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায় যে, কোনও দলেই অর্ধেকের বেশি অংশগ্রহণকারীরা সূচকের দশটি সেরা সম্ভাব্য জীবন চান না। সাধারণ ইচ্ছা ছিল একটি ৯।
যখন সূচকে পরিমাপ করা বাদ দেওয়া হয়েছে তখন দেখা গেছে যে সাধারণত তারা ৮টি সূচক চেয়েছিলেন যেখানে মানুষকে সম্পর্ক, মানসিক স্বাস্থ্য এবং কর্ম-জীবনের প্রতি ভারসাম্যের তারা ক্ষমতা ও সম্পদের বিষয়ে বেশি ভেবে থাকে।
এই র্যাংকিংয়ে দেখা যাচ্ছে ফিনল্যান্ড সবসময় চ্যাম্পিয়ন হয়। ঠিক আছে, তেবে এটি শুধুমাত্র সম্পদ ও ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে করা হয়েছে। যেখানে অন্যান্য বিষয়গুলোর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এর মানে এই নয় যে ফিনরা অসুখী, কিন্তু তারা যে ধরনের সুখের অধিকারী তা হয়ত ক্ষমতা এবং সম্পদ-কেন্দ্রিক।
আমাদের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল এই প্রশ্ন উত্থাপন করে যে আমরা কী ধরনের সুখ পরিমাপ করতে চাই। একজন ব্যক্তির সুখের ধারণা একজন গবেষক দ্বারা নির্ধারণ করা যায় না। এজন্য গবেষকদের অবশ্যই তাদের সুখের ধারণা সম্পর্কে লোকেদের জিজ্ঞাসা করতে হবে।
গবেষণায় দেখা গেছে যে মানুষ যখন সুখকে সংজ্ঞায়িত করে, তখন তারা শুধুমাত্র সম্পদ এবং মর্যাদাকে সামান্য পরিমাণে উল্লেখ করে। এটা সুপ্রতিষ্ঠিত যে অর্থ সুস্থতার সাথে সম্পর্কিত। কিন্তু অর্থের প্রভাব অন্যান্য অনেক সুখের কারণের তুলনায় দুর্বল, যেখানে ভালো মানের সামাজিক সম্পর্ক সবচেয়ে শক্তিশালী প্রভাব ফেলে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গবেষণা দেখা যায় যে, সুখ প্রকৃতপক্ষে মানুষকে আরও বেশি উৎপাদনশীল করে তোলে এবং কর্মক্ষেত্রে সুখের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল সম্পদের মালিকালা। অন্যদিকে, বেতনকে কর্মক্ষেত্রে সুখের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চালক বলে মনে করা হয়। তবে এটি ব্যক্তিগত সম্পদের মালিকানার চেয়ে কর্মক্ষেত্রে সুখের একটি দুর্বল চালক হিসাবে পরিণত হয়।
আমরা কি ধরনের সুখ পরিমাপ করতে চাই?
পূর্ববর্তী গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে ক্যানট্রিল ল্যাডার মানুষের আয়ের স্তর এবং সামাজিক অবস্থাকে অন্যান্য সুস্থতার মেট্রিক্সের তুলনায় একটি বড় মাত্রায় প্রতিফলিত করে। বর্তমান অধ্যয়ন আরও প্রমাণ যোগ করে যে সম্ভবত সহজ কিন্তু শক্তিশালী প্রশ্ন ভবিষ্যতে অতিরিক্ত প্রশ্নের সাথে সম্পূরক হতে পারে, মানুষ সুখ বলতে কী বোঝায় তা স্পষ্ট করতে।
আমাদের অধ্যয়নটি শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যে পরিচালিত হয়েছিল, তাই অবশ্যই এই বিষয়ের বৈশ্বিক প্রকৃতির কারণে এই গবেষণা অন্যান্য দেশেও করা উচিত। যাইহোক, আমাদের ফলাফলগুলি ইঙ্গিত দেয় যে আমরা অগত্যা এমনভাবে সুখ এবং মঙ্গল পরিমাপ করছি না যা আমরা আমাদের জীবনে সেই ধারণাগুলিকে কীভাবে সংজ্ঞায়িত করি তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
গবেষণার বাইরে অনুবাদকের আরও কিছু কথা
সুখী দেশের বাস্তবিক চিত্র খুঁজতে গিয়ে কয়েকটি বিষয় চোখে পড়েছে। যা চোখ কপালের উঠার মতো। ২০২৪ সালের সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকায় ইউরোপের দেশের সংখ্যাই বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গত সাত বছর ধরে ফিনল্যান্ড বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে।
তবে, ফিনল্যান্ড হচ্ছে ইউরোপের বিষণ্নতারোধী ওষুধ ব্যবহারের শীর্ষ তালিকার দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। একই কথা প্রযোজ্য সুইডেনের বেলাতেও যাদের অবস্থানও ভালো পর্যায়ে। রয়েছে আইসল্যান্ডের নামও। অর্থাৎ ইউরোপে সবচেয়ে বেশি বিষণ্নতারোধী ওষুধ ব্যবহারের রেকর্ড।
এদিকে, ভারতের অবস্থান রয়েছে সুখী দেশের তালিকার নিচের দিকে। তবে, আলাদা জরিপে দেশটির অবস্থান অনেক ওপরে। যেখানে চলক হিসেবে কর্মজীবনের ভারসাম্যকে তুলে ধরা হয়েছে। অন্যদিকে, আরেকটি প্রতিযোগিতাপূর্ণ প্রতিবেদন গ্লোবাল হ্যাপিনেস রিপোর্টে চীনকে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
(দ্য কনভারসেশন থেকে অনুবািদিত। মূল লেখক: আগস্ট নিলসন, সাংগঠনিক মনোবিজ্ঞানে পিএইচডি প্রার্থী, লুন্ড বিশ্ববিদ্যালয়।)