আহমদ মমতাজ এর বাড়িটি হতে পারে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বসত মিউজিয়াম

ফিচার ডেস্ক

বাড়ির পাশে ফেনী নদী। ও পাড়ে ভারত। ক্লান্ত পরিশ্রান্ত মানুষদের জন্য এ বাড়িটি ছিল আশ্রয় কেন্দ্র। দূরদূরান্ত থেকে আগত মানুষদের কাছে ছিল নির্ভরতার জায়গা। এক হাড়িতে রান্না করা খাবার খেতো হিন্দু মুসলিম সবাই। যারা এক হাড়িতে খাওয়ার অভ্যেস নেই, তাদের জন্য আলাদা করে ব্যবস্থা করা হতো শাকসবজি ও চালের৷ নিজেদের ইচ্ছেমতো রান্না করেই খেতেন তারা। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে এ বাড়িটিই হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধা সহ অন্যান্য মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র।

বলছিলাম আহমদ মমতাজের গ্ৰামের বাড়ি কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিল আশ্রয়কেন্দ্র। সুদূর চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে রামগড় হয়ে পাহাড়ি পথে মুক্তিযোদ্ধা ও মানুষ অনেক কষ্ট করে এ বাড়িতে এসে অবস্থান করত। বাড়িতে বসতঘর ছাড়াও বড় কাচারিঘর ঢেকিঘর সহ বেশ কয়েকটি ঘর ছিল। আগত বিপদগ্ৰস্থ মানুষদের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় গরু ঘরকে ও মাটি ফেলে বাসযোগ্য করা হয়েছিল।

ব্রিটিশ আমলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনকারি ঐ এলাকার চেয়ারম্যান গনু মিয়া চৌধুরী জায়গা সংকুলান না হওয়ায় সেই ঘরেই পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বিপদগ্ৰস্থ মানুষদের পাশে থেকে আহমদ মমতাজের বাবা মা পরিবারের সবাই সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন।

আহমদ মমতাজের বাবা নৌকার ব্যবস্থা করে নিরাপদে আশ্রয়ে থাকা মানুষদেরকে নদীর ওপারে ভারতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। অবিভক্ত বাংলার ব্যাবসায়ী হওয়ার কারণে ভারতে ও আবদুল বারিক সওদাগরের অনেক ব্যবসায়ী বন্ধু ছিল। তাদের মাধ্যমে তিনি এপার থেকে যাওয়া মানুষদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে পাকিস্তানি আর্মি বাড়িটা দখল করে নেয়। নিজেদের শেল্টারের জন্য ঘরের সব তছনছ করে প্রতিটি ঘরে বাংকার তৈরি করে। যার কারণে বাড়িটা আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া থেকে বেঁচে যায়।

আহমদ মমতাজ সারা জীবন বাড়িটাকে অপরিবর্তিত রেখেছেন। বাড়িটা তাঁর পিতার হাতে নির্মিত। বাড়িটির বয়স প্রায় ৮০ বছর। যুদ্ধকালীন সময়ের এ ধরনের ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি সারাদেশে অবিকৃত ভাবে খুব বেশি নেই। আহমদ মমতাজের নিজে হাতে সংরক্ষণ করে রাখা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এই অমূল্য গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক বাড়িটিকে স্থায়ী ভাবে সংরক্ষণের ব্যাবস্থা করা প্রয়োজন।

আহমদ মমতাজ একজন কিংবদন্তী। ড. আবদুল করিম মমতাজকে ইতিহাস চর্চায় উৎসাহ ও প্রেরণা জোগান। শিক্ষকতায় নিয়োজিত থাকাকালীন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্রকে নিয়ে তিনি পুরাকীর্তির সন্ধানে নেমেছিলেন। সুলতানী আমলে, মোগল আমলে নির্মিত বহু মসজিদ তিনি খুঁজে খুঁজে বের করেন এবং সেগুলির গাত্রে উৎকীর্ণ শিলালিপি উদ্ধার করে তার পাঠও নির্ণয় করেন। মমতাজও সেই দলের সঙে যুক্ত ছিলেন।

তার লেখালেখির শুরু একেবারে ছোটবেলায়, নবম শ্রেণিতে অধ্যায়নকালে। প্রথমে ছোটগল্প, পরবর্তীকালে রম্য গল্প ও প্রবন্ধ রচনায় হাত পাকান আশির দশকে ইতিহাস-ঐতিহ্য বিষয়ক তথ্য-উপকরণ সংগ্রহ শুরু করেন, ১৯৯২ সালের পর এই বিষয়ে পুরোদমে আত্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্য বিষয়ক ৬ শতাধিক প্রবন্ধ বিভিন্ন জার্নাল, জাতীয় ও আঞ্চলিক পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে। তন্মধ্যে বড় অংশই চট্টগ্রামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি-সাহিত্য বিষয়ক।

তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ ৭টি। প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে মীরসরাই’র ইতিহাস- সমাজ ও সংস্কৃতি, “শমসের গাজী ” দুই খণ্ডে চট্টগ্রামের সুফী সাধক ও বদর শাহ, চট্টগ্রামের মনীষীদের জীবন বৃত্তান্ত সংকলন “চট্টল মনীষা” উল্লেখযোগ্য। এছাড়া ভাষা আন্দোলনে চট্টগ্রাম, দুই বাংলার সুফী সাধক বদর শাহ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ-মরণজয়ী উপাখ্যানসহ ২০টি গ্রন্থ নিয়ে তিনি কাজ করছিলেন।

এ বিষয়ে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালযের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মুতাসিম বিল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাস বিবেচনায় ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য এ ধরণের বাড়ি সংরক্ষণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্মৃতি সংরক্ষণার্তে বাড়িটিকে ঘিরে একটা দারুন বসত মিউজিয়াম হতে পারে। যা ভবিষ্যত জেনারেশনকে মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের সীমানায় মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আশ্রয়স্থলের প্রেক্ষাপটকে বুঝতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version