বাংলার মধ্যযুগও কি ইউরোপের মতো অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল?

বাংলা ভাষা সাহিত্যে বেশকিছু অমর সাহিত্য রচনাও বাংলায় সংকলন করা হয় এই হোসেন শাহী রাজবংশের আমলে।

সুদীপ চাকমা

মধ্যযুগ শুনলেই আমাদের চোখে ভেসে আসে ইউরোপের বর্বর, অন্ধকার যুগের কথা। বাংলায়ও কি সেসময়ে এমনটি ছিল? ইতিহাসের তথ্য ও উপাত্ত আমাদের ভিন্ন কথা বলে। মধ্যযুগে বাংলার হোসেন শাহী রাজবংশের (১৪৯৩-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দ) শাসনামলকে পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঐ সময়ে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতির উন্নতি সহ বাংলা ভাষা সাহিত্যে ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয় এবং সে সময়ে বাংলায় অভ্যন্তরীণ শান্তি-শৃঙ্খলা উন্নতি সহ সম্ভ্রান্ত হিন্দুদের বসানো হয় বিভিন্ন উচ্চপদে। বাংলা ভাষা সাহিত্যে বেশকিছু অমর সাহিত্য রচনাও বাংলায় সংকলন করা হয় এই হোসেন শাহী রাজবংশের আমলে।

হোসেন শাহী রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আলাউদ্দিন হোসেন শাহ’র জন্ম সুদূর তুর্কিস্তানের তিরমিজ শহরে আরবি সৈয়দ বংশে। পরবর্তীতে তার পরিবার রাঢ়ের চাঁদপাড়া মৌজায় বসতি স্থাপন করলে সেখানে তার ভাইসহ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা স্থানীয় এক কাজীর নিকট সম্পন্ন হয়। কৃষ্ণদাস কবিরাজ তার ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন সৈয়দ হোসেন তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সম্পন্ন করে গৌড়ে এসে উচ্চ রাজকর্মচারী সুবুদ্ধি রায়ের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন। এরপর তিনি স্বীয় যোগ্যতাবলে হাবশীদের শেষ অত্যাচারী সুলতান মুজাফফর শাহের প্রধানমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হন।

১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মুজাফফর শাহকে উৎখাত করে তিনি বাংলার সিংহাসনে আহরণ করে নিজেকে আলাউদ্দিনিয়া-ওয়াল-দীন-আবুল-মুজাফফর-হোসেন শাহ্ উপাধিতে ভূষিত করেন। তারপরেও তিনি আলাউদ্দিন হোসেন শাহ নামে সমধিক পরিচিত।

সিংহাসনে আহরণ করে প্রথমে তিনি হাবশীদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করেন। তার সাথে তিনি প্রাসাদ ষড়যন্ত্রে ধ্বংসাত্মক ভূমিকা পালনকারী প্রাসাদ রক্ষী পাইকদের বিপরীতে নতুন রক্ষী দল গঠন করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সম্ভ্রান্ত হিন্দু মুসলমানদের নিযুক্ত করেন। ফলে তিনি বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম হন।

যেমন তার সময়ে পুরন্দর বসু নামে এক হিন্দুকে বর্ধমানের উজির পদে নিযুক্ত করেন, দবির-ই-খাস বা একান্ত সচিব পদে নিযুক্ত করেন সনাতন গোস্বামীকে, রাজস্ব সচিব পদে নিযুক্ত করেন রূপ গোস্বামীকে কে। এছাড়াও গৌড় মল্লিক ছিলেন হোসেন শাহের সেনাপতি, জগাই ও মাধাই ছিলেন নবদ্বীপের কোতোয়াল, কেশব ছত্রী ছিলেন, হোসেন শাহের দেহ রক্ষী ও মুকুন্দ দাস ছিলেন  সুলতান হোসেন শাহের ব্যক্তিগত চিকিৎসক।

এছাড়া হোসেন শাহের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু হিন্দু কবি সাহিত্যিক হিন্দুদের বিভিন্ন গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য মালাধর বসু কর্তৃক রচিত ‘শ্রীমদ্ভাগবৎ’ এবং ‘পূরাণ’, ১৪৯৪-৯৫ খ্রিষ্টাব্দে  বিজয় গুপ্ত কর্তৃক রচিত ‘পদ্মপুরাণ’, ১৪৯৫-৯৬ খ্রিষ্টাব্দে বিপ্রদাস  কর্তৃক  রচিত ‘মনসামঙ্গল’ বা মনসাবিজয় কাব্য, যশোরাজ কর্তৃক রচিত ‘শ্রীকৃষ্ণ বিজয়’, দ্বিজ জনার্দন কর্তৃক রচিত ‘চন্ডির উপ্যাখান’, ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে কবি কংকা কর্তৃক রচিত ‘বিদ্যাসুন্দর কাব্য’ এবং ‘কালিকামঙ্গল’ নামে দুটি কাব্য গ্রন্থ।

হোসেন শাহের শাসনামলের অধীনে থাকা চট্টগ্রামের শাসনকর্তা পরাগল খান ও ছুটি খান তারাও বাংলা ভাষা সাহিত্য রচনায় অভূতপূর্ব অবদান রাখেন। যেমন পরাগল খানের পৃষ্ঠপোষকতায় কবীন্দ্র পরমেশ্বর ‘মহাভারত’ ও ছুটি খানের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীকর নন্দী মহাভারতের ‘অশ্বমেধপর্ব’ বাংলায় অনুবাদ করেন।

দেখা যায় হোসেন শাহ গোঁড়া সুন্নি মুসলমান হলেও তার কর্মকাণ্ডে তিনি নিজেকে উদারতা ও পরধর্ম সহিষ্ণুতার পরিচয় দিয়েছেন। তাই হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি বৃদ্ধি ও বাংলা ভাষা সাহিত্যে অসামান্য অবদান রাখায় বিভিন্ন কবিগণ থাকে কৃষ্ণের অবতার, নৃপতি তিলক ও জগৎ ভূষণ উপাধিতে ভূষিত করেন।

বাংলা ভাষা সাহিত্যে অবদান রাখার পাশাপাশি  হোসেন শাহ আরবি ও ফারসি ভাষা সাহিত্যের সাথে সম্পৃক্ত বিভিন্ন কবি সাহিত্যিকদেরও পৃষ্ঠপোষকতা করেন। যেমন, মুহম্মদ বুদই ওরফে সৈয়দ মীর আলাওই ফার্সি ভাষায় ‘হিদায়তুল রামী’ নামে ধনুর্বিদ্যা বিষয়ক একটি গ্রন্থ রচনা করেন। খাওয়াজগী শেরওয়ানী হোসেন শাহের রাজকোষাগারের জন্য ‘শাহীহ্ আল বুখারী’ গ্রন্থের তিন খণ্ডের তিনটি অনুলিপি সংকলন করেন। কবি শাহ মুহম্মদ সগীর কর্তৃক রচিত অমর প্রেমের উপ্যাখান ‘ইউসুফ জুলেখা’ হোসেন শাহী রাজবংশের সুলতান মাহমুদ শাহের শাসনামলের সময় ১৫৩২-১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দের সময়কার রচিত হয়।

বাংলার শিল্পকলার ক্ষেত্রেও হোসেন শাহী রাজবংশের অবদান অনস্বীকার্য। তারা দেশের সর্বত্র মসজিদ, মাদ্রাসা, খানকাহ, নির্মাণ করেন। গৌড়ের ছোট সোনা মসজিদ, সুরা মসজিদ ও সোনারগাঁওয়ের গোয়ালাদি মসজিদ সুলতান হোসেন শাহের কাজের অনন্য কীর্তি। এছাড়া সুলতান নুসরত শাহ তার শাসনামলে গৌড়ের বড় সোনা মসজিদ ও রাজশাহীতে বাঘা মসজিদ নির্মিত হয়।

অর্থাৎ বাংলায় ইলিয়াস শাহী সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় স্থাপত্য, হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি ও বাংলা ভাষা চর্চার যে সূত্রপাত ঘটে। তা হোসেন শাহী রাজবংশের শাসনামলে এসে বহুলাংশে বেড়ে যায়।

তথ্যসূত্র – বাংলার ইতিহাস, মো. আইয়ুব খান।

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version