পেশায় ব্যাংকার হলেও নেশা তাঁর অতীতের শেকড়ের সন্ধান

ছোটবেলা থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পড়াশোনার জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন। তবে শৈশবটা কেটেছে নিজ বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। বহুমুখী কাজে পারদর্শী ওসমান গণি সমাজের অন্য সবার চাইতে একটু আলাদাভাবেই মেলে ধরেছেন নিজেকে। জানার মাঝে অজানার সন্ধান করতে গিয়ে ব্যাংকার হয়েও খোঁজে পেয়েছেন ইন্দ্র রাজার বাড়ি। জানেন প্রাথমিক চিকিৎসা, জোতির্বিদ্যা সহ প্রত্নতাত্ত্বিক বোঝাপড়াও। লিখেছেন বই, পত্রিকায় উঠে আসে নিজস্ব মতামতও।

নাম ওসমান গনি এনু। ছোটবেলা থেকেই দেশের বিভিন্ন স্থানে পড়াশোনার জন্য ছুটে বেড়িয়েছেন। তবে শৈশবটা কেটেছে নিজ বাড়ি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। বহুমুখী কাজে পারদর্শী ওসমান গণি সমাজের অন্য সবার চাইতে একটু আলাদাভাবেই মেলে ধরেছেন নিজেকে। জানার মাঝে অজানার সন্ধান করতে গিয়ে ব্যাংকার হয়েও খোঁজে পেয়েছেন ইন্দ্র রাজার বাড়ি। চর্চা করেছেন হোমিওপ্যাথি, লিখেছেন বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, যখন যা মন চেয়েছে সে বিষয়ে তিনি কলম ধরেছেন। রয়েছে জোতির্বিদ্যার পাশাপাশি প্রত্নতাত্ত্বিক  বোঝাপড়াও। লিখেছেন বই, পত্রিকায় উঠে আসে নিজস্ব মতামতও। নিজের কাজের মাধ্যমে বর্ণাঢ্য এক জীবন গড়ে তুলেছেন তিনি। তার কথা তুলে ধরেছে বিডিফিচার…।

বিডিফিচার: আপনার জীবনের বেড়ে ওঠার গল্প শুনতে চাই।

ওসমান গণি: মায়ের কাছে শুনেছি ১৯৫৯ সনের অগ্রহায়ণ মাসের এক চাঁদনি রাতের শেষ প্রহরে আমার জন্ম হয়েছিল। আমি পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনার জন্য মায়ের কঠোর শাসনে ছিলাম। প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বড় কমলদহ প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া-আসার মধ্যদিয়ে। ৪র্থ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বাবাকে হারালে মায়ের শক্ত মনোবল আমাদের পড়াশোনার মনোবল জুগিয়েছে। ফলে পড়াশোনার জন্য কোথাও বড়ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হই কুমিল্লার কসবা হাইস্কুলে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অষ্টম শ্রেণীতে আমি বৃত্তি পাই। তখন মেজভাই ও সেজভাই ইন্ডিয়াতে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং এ।

যুদ্ধের খবর আর দেশাত্নবোধক গান রেডিওতে শুনতে শুনতে প্রচণ্ড রকম উত্তেজিত হয়ে যেতাম। হঠাৎ একদিন কবিতা লেখা শুরু করলাম। তবে সে লেখাগুলো এখন আর সংগ্রহে নেই। একটি পুরনো ডায়েরিতে এখনো বড় একটি কবিতা রয়েছে। স্বাধীন হলে গ্রামের পাশে সরকার হাট এন আর হাইস্কুলে ভর্তি হয়ে যাই। তখন থেকেই লেখালেখি, মঞ্চনাটক, আবৃত্তি ইত্যাদির সাথে জড়িত হয়ে যায়। ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েও ডাক্তার না হওয়ার আক্ষেপ ছিল আমার। সেসময় চট্টগ্রাম কলেজে এসে সাহিত্য সংগঠন চাঁদের হাট, সবুজ সাহিত্য আসরে যোগ দিয়ে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। এখানেও সাহিত্য চর্চায় সময় বেশিই দিতাম। এই চট্টগ্রাম কলেজেই পরিচয় হয় সলিমুল্লাহ খান, আইউব সৈয়দ সাহাবুদ্দিন নাগরী আজয় দাস গুপ্ত, সামছুদ্দিন হারুন সহ আরও অনেক প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকের সাথে।

বিডিফিচার: জীবনে নতুন নতুন কিছুর সাথে যুক্ত হওয়ার অনুপ্রেরণা গল্প শুনতে চাই।  

ওসমান গণি: আমি ব্যাংকিং সার্ভিসে যোগ দিই ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৬ সালে আমাকে শাখা ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব দেওয়া হয়। জীবনের প্রতিটি বিষয়ে আমি আমার নিজস্ব চিন্তা এবং আমার স্বকীয় সিদ্ধান্ত ও কৌশলকে সবসময় প্রাধান্য দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ি। এক্ষেত্রে এমনও হয়েছে যা আমার বিষয় নয়, তাই আমি চর্চা করে পড়ালেখা করে রপ্ত করেছি। যেমন, ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হয়ে হোমিওপ্যাথিক চর্চা করে পারিবারিক চিকিৎসাসহ অনেক আত্মীয়কে চিকিৎসা দিয়েছি। অ্যাস্ট্রোলজি চর্চা করে হস্তরেখাবিদ হওয়া, পাথর বিশেষজ্ঞ হওয়ার জন্য ইন্ডিয়া থেকে প্রচুর বই এনে চর্চা করেছি। চাকরির পাশাপাশি ব্যবসা করতে গিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছি। অজানা বিষয়ের প্রতি প্রবল অনুরাগের প্রভাবেই ইন্দ্র রাজার বাড়ি আবিষ্কার করি। লেখালেখির ক্ষেত্রেও আমি বৈচিত্র্যকে সন্ধান করি। সবসময় যেমন-গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, ব্যাংকিং, হাদিস অনুবাদ, প্রণোদনামূলক বিষয়, ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, শিশু সাহিত্যসহ সকল বিষয়ে আমি চর্চা করেছি, লেখালেখি করেছি। কতটুকু করতে পেরেছি জানি না, কিন্তু চেষ্টা করেছি।

বিডিফিচার: কখনো হোঁচট খেয়ে থাকলে সে গল্পগুলো শুনতে চাই।

ওসমান গণি: জীবনে প্রথম হোঁচট খেয়েছি পিতার মৃত্যুতে। ২য় বার হোঁচট খেয়েছি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পর ডাক্তারিতে ভর্তি হতে না পারায়। কারণ তখন আমি আমার  পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। তবে সেসময় আমি সংগ্রাম করে টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করতে পেরেছি। তখন নাজিরহাট কলেজে ভর্তি হলে লজিং থেকে পড়াশোনা করা, বামপন্থি রাজনীতির সাথে যুক্ত হওয়া এবং সাধারণ মানুষের জীবন সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছি। সময়টা তখন ১৯৭৭-১৯৭৯ সালের। এই সময়টায় আমার লেখা কাব্যগ্রন্থ ‘এক স্বপ্নের গল্প’ এর সব কবিতাই তখন লেখা হয়েছে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি অর্জন করি। পরে বিআরসি পরীক্ষা দিয়ে ব্যাংকে যোগদান করি। এই ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ সময়টা আমার জীবনের স্বশিক্ষা কাল।

বিডিফিচার: ব্যস্ততার মাঝেও কীভাবে লেখালেখির সাথে যুক্ত থাকেন?

ওসমান গণি: লেখালেখির বিষয়টা একজন লেখকের একান্তই নিজের। মনোজগতের মিথস্ক্রিয়ার পরিণতি হলো তার লেখা বা সৃষ্টি। আর এই মিথস্ক্রিয়া যখন সক্রিয় থাকে তখন লেখক হাতে কলম নিয়ে বসে পড়ে। দৈনন্দিন কাজকর্ম, দায়দায়িত্ব যায় কিছু থাকুক না কেন, তার মাঝেও সময় করে লেখার সরঞ্জাম নিয়ে সে বসে পড়ে। এভাবেই চলে সাহিত্য সৃষ্টি।

আমার প্রথম উপন্যাস আমি লেখা শুরু করেছিলাম ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপককের দায়িত্ব নেওয়ার পর। অফিস শেষে বিকেলে লেখা শুরু করতাম। কাজের পাশাপাশি লেখালেখির জন্য কখনো কখনো কিছু ভুলত্রুটি হয়ে গেলে অসাধু কর্মকর্তারা এই দুর্বলতার সুযোগ নিত। পরে আমি ছুটির দিন এবং গভীর রাতে লিখতাম। গবেষণাধর্মী লেখা লিখতে গিয়ে আমাকে ছুটি নিতে হত। ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ির নিরালা নির্জন বাড়িতে একা একা লিখতাম। আমি শীত গ্রীষ্ম, বর্ষায় কোন বড় লেখা লিখি না। আমার লেখার সময় শরৎ ও হেমন্ত কাল। এই সময়েই আমি কর্মস্থল থেকে প্রায়ই ছুটি নিয়ে শ্বশুর বাড়ি নয়তো নিজের গ্রামের বাড়ির নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশকে বেছে নিতাম। তাই কর্মক্ষেত্রের ব্যস্ততা আমার লেখায় বাধা হয় নাই।

বিডিফিচার: আপনার জীবনের সেরা গল্প কি?

ওসমান গণি: একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে স্বচক্ষে দেখা, হৃদয় দিয়ে অনুভব করা এবং তার সাথে যুক্ত হওয়ার গল্প আমার জীবনের সেরা গল্পগুলির একটি। তবে রোমাঞ্চকর এক গল্প হলো নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে ইন্দ্র রাজার বাড়ি আবিষ্কার এবং মার্কিন যুক্তরাস্ট্র থেকে ইটের টুকরার বয়স পরীক্ষার প্রত্যয়নপত্র অর্জন। ৩য় সেরা গল্প হলো এ পর্যন্ত তিনটি মসজিদের প্রতিষ্ঠা, নির্মাণ ও পরিচালনার, সাথে যুক্ত থাকা দীর্ঘ ৩০ বছর থেকে আমি এই কর্মে নিযুক্ত থেকে নিজকে ধন্য করেছি। তবে সবচেয়ে সেরা গল্প হলো কর্মজীবনে পা দিয়ে নিজ গ্রামের নিরক্ষর মানুষের জন্য নিজের জমিতে (মা প্রদত্ত) নিজ উদ্যোগে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। গ্রামের অসচ্ছল পরিবারের ছেলে মেয়েরা স্কুলে যেত না, তারা যেত পাহাড়ে। গ্রামে শিক্ষার হার ছিল ২/৩ শতাংশ।  যা আমাকে সবসময় মনঃকষ্ট দিত। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে কর্ম জীবনের ৫ বছরের মধ্যে সম্পূর্ণ নিজের প্রচেষ্টা এই স্কুল প্রতিষ্ঠাই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ গল্প।

বিডিফিচার: আপনার প্রত্নতত্ত্ব সর্ম্পকে আগ্রহী হওয়ায় কারণ কি?

ওসমান গণি: আমি মূলত ঐতিহ্য প্রেমী মানুষ। অথবা বলা যায় অতীত প্রীতি বা হেলেনিজম এ প্রায়ই বুঁদ হয়ে থাকি। এই অভ্যাসটাই আমাকে সবসময় আমার, আমার পিতামহ, প্রপিতামহ এদের অতীত ঐতিহ্য; তাঁদের কর্ম, এ দেশে আগমন ইত্যাদি নিয়ে ভাবালুতায় ভুগতাম। সবসময় চেষ্টা করতাম এসবের খোঁজখবর নেয়ার; পুরোনো কাগজপত্র দাখিলা, দলিল, পাঠ্রা ইত্যাদি খুঁজতে খুঁজতে একদিন আমাদের আদি মল্ল (মল্লা) বাড়িতে যাই। যেখানে বিশাল এক দীঘির মত বড় পুকুর বাধানো ঘাট। পূর্ব পাড়ে আদিকালের কবরস্থান আছে। ঐ বাড়িতে পুরানো লোকদের সাথে বসে কথা বলার এক পর্যায়ে জানতে পারি আমাদের পূর্ব দিকের পাহাড়ে একটা রাজার বাড়ি আছে। যার চিহ্ন এখন নাই তবে খুঁজলে বা মাটি খুঁড়লে পাওয়া যাবে। আমি স্তব্ধ হয়ে ভাবতে থাকলাম এটাও কি সম্ভব? আমার ৫০ বছর বয়স পর্যন্ত যে গল্প জানলাম না, যে পাহাড়ের নিচে কেটেছে আমার শৈশব কৈশোর যে মুরলী ছড়ায় ছোটবেলায় ছোট ছোট চিংড়ী মাছ ধরতাম সবাই মিলে সে ছড়ার পাশে ইন্দ্র পাহাড়ের কথা কেউ কখনো বলেনি। মনে পড়লো শৈশবে রেল সড়কের নিচে ছড়ায় মাছ ধরার সময় ছোট ছোট অনেক ইটের টুকরো পেতাম; চিন্তা করতাম, পাহাড়ি ঢলে পাথর আসার কথা ইটের টুকরা কেন আসবে? এই প্রশ্নের উত্তর তখন পাই নাই। এখন মনে হলো ইন্দ্ররাজার বাড়ি হয়ত ছড়ার কোন একপাশে থাকবে। দেরি না করে এক মাসের মধ্যে দলবল নিয়ে ইন্দ্র পাহাড়ে উঠি এবং বেছে বেছে বিভিন্ন জায়গায় খন্তা কোদাল দিয়ে মাটি খুঁড়তে থাকি। কিন্তু কিছুই খুঁজে পাইনি তবে পুরোনো ইটের ভাঙ্গা টুকরো পেয়েছি এখানে সেখানে পড়ে আছে।

পরের মাসে আবারও যাই। কিছুই পাইনি। পরের বছর একই সময়ে আবার ও যাই। এরপর পেয়ে যাই। তারপর সেখানে পাওয়া ইটের টুকরো আর অন্যান্য চিহ্ন দিয়ে ‘ইন্দ্ররাজার বাড়ি প্রত্নতাত্ত্বিক বিস্ময়’ বইটি লিখি।

বিডিফিচার: আগামী প্রজন্মের জন্য আপনার পরামর্শ কি?

ওসমান গণি: নিজকে স্বশিক্ষিত করে গড়ে তোলা যে শিক্ষার সাথে শুধু স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্ম্পক নয়, সর্ম্পক থাকবে মা-বাবার, পরিবেশের, প্রকৃতির তথা নিজ গ্রামের; সর্বোপরি নিজ দেশের। অর্থাৎ নিজের পরিবার নিজের গ্রাম এবং নিজের দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসাতে পারা ছাড়া কোন শিক্ষাই পরিপূর্ণতা পায় না; যা আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি এবং মেনে চলি। শুধু নিজের জন্য নিজের প্রতিষ্ঠার জন্য যে শিক্ষা সে শিক্ষা মানহীন মলিনতায় পূর্ণ হয়ে থাকে; সত্যিকার সুখ সেখানে অনুপস্থিত।

বিডিফিচার: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। 

ওসমান গণি: বিডিফিচারকেও ধন্যবাদ।

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version