ইন্দোনেশিয়ার বালি ও জাভায় ফিরে আসছে নোনাজলের কুমির

শাহাদাত হোসেন

চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি ইন্দোনেশিয়ার বালিতে সমুদ্র থেকে প্রায় তিন মিটারের একটি নোনাজলের কুমির উঠে আসে। বালির অন্যতম জনপ্রিয় বিচ লিজিয়ানে কুমিরটির সাথে কোনো অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি। তবুও এ সরীসৃপটি পরে মারা যায়।

এর মাত্র চার মাস পর, বালি থেকে ১০০ কিলোমিটার পূর্বে লম্বুকস আওয়াং উপসাগরে বন্ধুদের সাথে বর্শা দিয়ে মাছ ধরতে গেলে কুমিরের আক্রমণে একজন নিহত হন। পরে কর্তৃপক্ষ কুমিরটিকে আটক আটক করে বন্দিদশায় হস্তান্তর করে।

একসময় ইন্দোনেশিয়ার বেশিরভাগ পানিতেই নোনাজলের কুমির ঘোরাফেরা করতো। কিছু অঞ্চলে এখনও কুমিরের আক্রমণের ঘটনা স্বাভাবিক। যদিও বালি দ্বীপে কুমিরের উপস্থিতি একটু অস্বাভাবিকই। কারণ বালি, লম্বুক ও জাভার কুমিরগুলোকে পরিকল্পিতভাবে মেরে ফেলা হয়েছিল।

২০১০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী কুমিরের বিভিন্ন আক্রমণের তথ্য সংগ্রহ করেন ক্রোক-অ্যাটাকের প্রতিষ্ঠাতা ব্র্যান্ডন মাইকেল সিডেলো। নতুন করে কি এমন ঘটেছে যে, নিশ্চিহ্ন হওয়া এলাকায় নোনাজলের কুমির আবার ফিরতে শুরু করেছে।

এর অর্থ পর্যটক ও বসবাসকারীদের সতর্ক হওয়া উচিত? প্রশস্ত বিবেচনায় জনসংখ্যার ঘনত্ব একই এমন কাছাকাছি কোথাও এ দ্বীপগুলোর মানুষকে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব। আবার পর্যটক ও উচ্চ জনসংখ্যার এসব সমুদ্র সৈকতের গুরুত্বের কারণে এখানে কুমিরের পুনরুদ্ধারও করা সম্ভব হবে না।

ইন্দোনেশিয়ার কুমিরের কি হয়েছিল?

নোনাজলের কুমির মোহনার কুমির নামেও পরিচিত। তারা ম্যানগ্রোভ রেখার নদীগুলোতে বসবাস করতে পছন্দ করে। নোনাজলের কুমির হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জীবন্ত সরীসৃপ। লম্বায় এটি সাত মিটার পর্যন্ত হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার বিখ্যাত কমোডো ড্রাগনের চেয়ে এটি বেশ বড়। কারণ কমোডো ড্রাগন সর্বোচ্চ তিন মিটার হয়

ঐতিহাসিকভাবে ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জ জুড়ে কুমির বসবাস করতো। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে বালিতে এবং ১৯৫০ সাল পর্যন্ত জাভা জুড়ে মানুষের উপর কুমিরের আক্রমণের ইতিহাস রয়েছে। এমনকি ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা অনেক নদীতে কুমিরের আবাসস্থল ছিল।

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে বালি ও লম্বুকের এবং এর পরবর্তী সময়ে জাভার কুমিরগুলোকে মেরে ফেলা হয়। কিন্তু তারা দ্বীপ রাষ্ট্রের আরও প্রত্যন্ত অঞ্চলে টিকে ছিল।

রাজধানী জাকার্তার সমুদ্রসহ ইন্দোনেশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ জাভায় এখন নিয়মিত লবণাক্ততা দেখা যাচ্ছে। প্রতিবছর দ্বীপপুঞ্জগুলোতে অন্তত ৭০ জন মানুষ কুমিরের আক্রমণে মৃত্যুবরণ করেন। সুমাত্রার কাছে অবস্থিত বাংকা-বেলিতুং দ্বীপপুঞ্জ এবং পূর্ব কালিমান্তান, পূর্ব নুসা টেঙ্গারা এবং রিয়াউ প্রদেশে সবচেয়ে বেশি আক্রমণের ঘটনা ঘটে।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার অর্থ কুমিরের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু ঠিক আগের মতোই কুমিরের সংখ্যা হবে এমনটা নাও হতে পারে। ইন্দোনেশিয়ার অনেক দ্বীপে কুমিরের আবাসস্থল উপযোগী খুব কম ম্যানগ্রোভ রয়েছে এবং প্রাকৃতিকভাবে সমুদ্র থেকে আসা অনেক নদী ও খাল এতোই ছোট যেখানে খুব অল্প সংখ্যক কুমির বসবাস করতে পারে। এমনকি অল্প সংখ্যক কুমিরের পুনরুদ্ধার হলে এসব খাল বা নদীর ধারণক্ষমতা পূরণ হয়ে যাবে। এই কুমিরগুলো পৃথিবীর সব কুমিরের মধ্যে আঞ্চলিক। প্রভাবশালী পুরুষ কুমির ছোট কুমিরগুলোকে বের করে দেয় যেন তারা নতুন আবাসস্থলের খোঁজে বেরিয়ে পড়ে।

আজ পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার কুমির নিয়ে যত জরিপ হয়েছে বেশিরভাগই ছোট এবং কম ঘনত্বের সংখ্যা প্রকাশ করে। কিন্তু মানুষের বসবাসকৃত অঞ্চলে এককভাবে কোন কুমিরের ফিরে আসা সংঘর্ষের জন্ম দিতে পারে এবং এ প্রজাতির সংরক্ষণ হুমকির মুখে পড়তে পারে।

বিশ্বব্যাপী নোনাপানির কুমিরকে আইইউসিএনের হুমকির মুখে থাকা লাল তালিকাভুক্ত প্রজাতি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৭০ সালের শুরুর দিকে উত্তর অস্ট্রেলিয়ায় শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণার পর এ প্রজাতিটি পুরোপুরি পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়। কিন্তু কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামে এ প্রজাতিটি এখন বিলুপ্ত।

অল্প জনসংখ্যার উত্তর অস্ট্রেলিয়াতে এখনও মানুষ ও কুমিরের মধ্যে দ্বন্দ্ব রয়েছে যা তুলনামুলকভাবে বিরল। ইন্দোনেশিয়ায় জনসংখ্যা বেশি হওয়ায় কুমিরের আবাসস্থলের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।

বালির কুমির কোথা থেকে আসছে?

ম্যাপ দেখে মনে হতে পারে বালিতে ফিরে আসা কুমিরগুলো অস্ট্রেলিয়া থেকে আসছে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে কুমির চলাচলের এখনও গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ নেই। অস্ট্রেলিয়া থেকে বালিতে আসতে কুমিরকে এক হাজার কিলোমিটার সাঁতার কাটতে হবে।

ধারণা করা যায়, কোন কাছাকাছি স্থান থেকে এসব কুমির আসছে। যদিও এটা প্রমাণ করার জন্য জেনেটিক বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ বেঁচে থাকা কুমিরের কেন্দ্রগুলো অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেক কাছে। বালি ও লম্বুকের কারণে সম্ভবত দ্বীপগুলো থেকে পূর্বদিকে যেমন ফ্লোরেস, লেম্বাটা, সুম্বা এবং তিমুরের দিকে কুমির চলে যাচ্ছে।

জাভাতে কুমিরের আগমনের সবচেয়ে সম্ভাব্য উৎস হলো সুমাত্রা, যা জাভা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটারেরও কম দূরে অবস্থিত। এই এলাকা দীর্ঘদিন ধরে কুমিরের আক্রমণ প্রবণ।

বাসিন্দা ও পর্যটকদের জন্য এটা কি বার্তা দিচ্ছে?

এ মাসের শুরুতে গিলি দ্বীপের পর্যটন এলাকা থেকে ৫০ কিলোমিটারেরও দূরে পশ্চিম লম্বুকের একটি বড় মাছের ফাঁদে অপেক্ষাকৃত একটি বড় কুমিরের ছবি তোলা হয়েছিল। কুমিরের উপস্থিতি ও আক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে আমাদের খুঁজতে হবে কীভাবে এ সরীসৃপগুলোর সাথে পাশাপাশি বসবাস করা যায়। পশ্চিম জাভা ও লম্বুকের মোহনা এবং উপকূলীয় পানিতে এখন সম্ভবত কমসংখ্যক কুমিরের বসবাস।

আক্রমণ প্রতিরোধে কি করা যেতে পারে?

প্রথমত, মানুষকে জানতে হবে কুমিররা ফিরে এসেছে। কুমির নিয়ে মানুষের মাঝে সচেতনতা ও সতর্কতা বৃদ্ধি জীবন বাঁচাতে বড় ভূমিকা রাখবে। কিছু গবেষক এটা বিশ্বাস করেন যে, আমাদের এবং গবাদি পশুর উপর আক্রমণের সম্ভাবনা বেড়ে যাবে যদি ম্যানগ্রোভ ধ্বংস হয় এবং মাছ ধরার জায়গাগুলোতে মাছ ধরা হয়। বাসস্থান ও এর শিকার প্রজাতিকে রক্ষার মাধ্যমে কুমিরের ভবিষ্যৎ রক্ষা করা যাবে এবং আক্রমণের ঝুঁকি কমে আসবে।

এর মানে পর্যটকদের পরবর্তী বালি ভ্রমণ বাতিল করা উচিত হবে? মোটেও না। যদিও পুনরুদ্ধারের প্রচেষ্টার মাধ্যমে বালির উপকূল রেখা বরাবর ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ফিরিয়ে এনেছে, তবে এ দ্বীপটির অতি জনপ্রিয়তার কারণে কুমিরের জনসংখ্যা পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।

কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি কুমির ধীরে ধীরে জাভা ও লম্বুকের কম জনসংখ্যার অংশে ফিরে আসছে। যদিও এটা আমাদের উদ্বেগ দূর করতে পারে, তারা বাস্তুসংস্থানের একটি বৃহৎ অংশ।

(দি কনভারসেশন থেকে অনুবাদিত)

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version