শতাব্দীর স্মারক তিতাসের নৌকাবাইচ

১৯০৮ সালে অনুষ্ঠিত নৌকা বাইচ ছিল একটি ঐতিহাসিক প্রতিযোগিতা। ঐ প্রতিযোগিতায় আখাউড়া, আশুগঞ্জ, চান্দুরা এবং কুটির ইংরেজ পাট ব্যবসায়ীরা বহু সোনার মেডেল দিয়ে নৌকা বাইচ প্রতিযোগীদের পুরস্কৃত করেছিলেন।

জুবায়ের রহমান

শতবর্ষে পূর্বে জন্ম আমার। শতবর্ষ পেরিয়েও আমি লোকান্তরে বিদ্যমান। আমাকে ভুলে যাওয়া অত সহজ নয়। যতবার আমাকে ভুলে যাবে, আমি নতুন করে ততবার তোমার কাছে ফিরে আসব তোমার নতুনত্বকে আলিঙ্গন করে। আমার কোলেই যে একদা ছিল তোমার বিচরণ। আমার তীরেই বসে তুমি সৃষ্টি করেছ অজস্র কবিতা আর উপন্যাস। আমার পাড়েই ভিড়িয়েছ তরী, ডিঙ্গিয়েছ পথ। আমাকে ভুলে যাওয়া অত সহজ নয়। ইতিহাসের প্রতিটি পাতায় পাতায় যে আমারে দিয়ে গেছো স্থান। দূর থেকে দূরান্তে, কাছে কিংবা দূরে। মনে আমাকে পড়বেই। আমি আছি তোমাদের মাঝে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।

বলছিলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রাণ তিতাস নদীর কথা। তিতাসকে নিয়ে লেখক অদ্বৈত মল্লবর্বণ রচনা করেছিলেন তার কালজয়ী উপন্যাস ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এছাড়াও জগদ্বিখ্যাত অনেক ব্যক্তির কাজকর্ম তিতাসকে করেছে আরও সমৃদ্ধ। ফলে কালে কালে গ্রাম বাংলার আপামর জনতার কাছে একটি প্রিয় নাম তিতাস।

সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস নদীর শতাব্দীর স্মারক নৌকাবাইচ। যার সূচনা হয়েছিল ১৯০৮ সালে। সুদূর অতীত কাল থেকে মনসা পূজা উপলক্ষ্যে ভাদ্র মাসের প্রথম তারিখে তিতাসে এ নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হতো। সময়ের পরিবর্তনে সেই তারিখের পরিবর্তন আসলেও জেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত এ নৌকা বাইচের সেই উচ্ছ্বাস বর্তমানে কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে। যা দেখতে ভিড় করে দূরদূরান্তের দর্শনার্থীরাও।

নৌকাতে প্রস্তুত মাল্লারা

তিতাসের বুকে নৌকাবাইচের সূচনা হয়েছিল ইংরেজ পাট ব্যবসায়ীদের হাত ধরেই। ত্রিপুরা জেলা গেজেটীয়ার থেকে জানা যায় যে, ১৯০৮ সালে অনুষ্ঠিত নৌকা বাইচ ছিল একটি ঐতিহাসিক প্রতিযোগিতা। ঐ প্রতিযোগিতায় আখাউড়া, আশুগঞ্জ, চান্দুরা এবং কুটির ইংরেজ পাট ব্যবসায়ীরা বহু সোনার মেডেল দিয়ে নৌকা বাইচ প্রতিযোগীদের পুরস্কৃত করেছিলেন।

আরেকটি তথ্য থেকে জানা যায়, কুমিল্লা জেলা গেজেটীয়ার থেকে ব্রিটিশ শাসনামলে নৌকা বাইচ সর্ম্পকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক মি. ওয়ারস এর রিপোর্টের বর্ণনায় আরো জানা যায় যে, এখানে নিয়ম-দস্ত  মাফিক কোন নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হতো না। সাধারণ একটি নৌকা আর একটি নৌকাকে চ্যালেঞ্জ দিত এবং দাঁড়িরা তালে তালে দাঁড় ফেলে পাল্লা দিয়ে নৌকা চালিয়ে নিয়ে যেত। একটি নৌকা আর একটি নৌকাকে পেছনে ফেলে দিতে পারলেই তার বিজয় হতো।

১৯০৮ সালে আখাউড়ার কয়েকটি পাট কোম্পানির দেওয়া স্বর্ণ পদকের জন্য দস্তুরমতো নৌকা বাইচ হয়েছিল। তাতে এমন উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল যে, মানুষের পক্ষে সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি। পরে তৎকালীন পুলিশ বহু কষ্টে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হয়েছিল।

ত্রিশের দশকেও ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর সংলগ্ন তিতাসের বুকে অতি জাঁকজমকের সাথে গণ উৎসব এ নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হতো। বিজয়ী নৌকাকে মেডেল, কাপ, শীল্ড, পিতলের কলস, পাঁঠা ইত্যাদি ট্রফি দেয়া হতো। নৌকা বাইচ উপলক্ষ্যে লঞ্চ, বিভিন্ন ধরনের নৌকা, কোষা, কলাগাছের ভেলা, এমনকি মাটির গামলাকে পর্যন্ত রং-বেরঙের কাগজের ফুল দিয়ে বিচিত্র সাজে সজ্জিত করা হতো।

নৌকাবাইচের তালে তালে গারন গাওয়া নৌকা বাইচের একটি রীতি। ‘‘সখী করি গো মানা, কালো জলে ঢেউ দিও না গো, সখী কালো জলে ঢেউ দিও না’’ ইংরেজ আমলে তিতাস নদীর নৌকা বাইচের একটি গানের অংশ এটি। সময়ের পরিবর্তনে গানের তালেও পরিবর্তনও এসেছে বেশ। ঢেউয়ের কলতান, হেইয়োরে হেঁইয়ো আর সারিবদ্ধ বৈঠার ছলাত ছলাত শব্দে উচ্ছ্বসিত হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী।

শহরের কোল ঘেঁষে যে তিতাসের যে অংশটি বয়ে গেছে এখন সেখানেই বসে প্রতিযোগিতার আসর। দেশের বিভিন্ন জেলার নৌকা বাইচের প্রতিযোগীরা সেখানে অংশগ্রহণ করে থাকেন। ভাদ্রের প্রচণ্ড রোদ উপেক্ষা করে নদীর দু পাড় ভিড় করে হাজার হাজার হাজার মানুষ। উপভোগ করেন শতাব্দীর প্রাচীন এই নৌকাবাইচ।

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version