আনিসুর রহমান
“As Gregor Samsa awoke one morning from uneasy dreams he found himself transformed in his bed into a gigantic insect” ( এক সকালে গ্রেগর সামসা অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখল সে তাঁর বিছানায় এক দৈত্যাকার পোকায় রূপান্তরিত হয়ে পড়ে আছে)। এমন আকস্মিক ও চমক জাগানো একটি লাইন দিয়ে ফ্রানৎস কাফকা শুরু করেছেন তার স্বীকৃত নভেলা দ্যা মেটামরফোসিস। বাস্তবিক জীবন থেকে বহুদূরে এমন এক কাল্পনিক ও অবাস্তব প্রেক্ষাপটে নিয়ে গল্পটি লিখা হয়েছে, যা আপনাকে বাস্তবতার মিলন দেখিয়ে স্বপ্নের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিবে। চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে বাস্তবতার এক মিল খুঁজে পাবেন এই গল্পে।
কাল্পনিক ঘটনার আড়ালে লেখক মূলত বইটিতে সময়ের ব্যবধানে মানুষের আচরণ বদলে যাওয়ার একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। যেখানে জীবন হয়ে উঠে দুর্বিষহ, বেড়ে যায় অন্যায়-অবিচার। কামনা করে মানুষের মৃত্যুর। আর বইটিও লেখক এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, নায়কের শেষ পরিণতি না জেনে আপনিও ক্ষান্ত হবেন না। মোটামুটি সমান দৈর্ঘ্যের তিন অংশের মাঝে প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের মধ্যকার ব্যবধান একদিনের, আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশের ব্যবধান অনিশ্চিত কালের। তো চলুন দেখে আসি কল্পকাহিনির আড়ালে সমাজ বাস্তবতার রূপরেখা।
১.
উপন্যাসিকাটির প্রথম অংশে দেখানো হয় গ্রেগর সামসা একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখতে পায় তার ইয়া বড় বড় পা গজিয়েছে। যা দেখতে বিশালাকৃতির পোকার মতো। এমনকি তার কণ্ঠস্বরও পোকার মতো কিচকিচ শব্দ বের হতে শুরু করেছে। তখন সে ভাবতে থাকলো যেহেতু সে একজন সেলসম্যান তাই তার এই অবস্থার কারণে চাকরি চলে গেলে তাঁর পিতা-মাতা ও ছোট বোনের জীবন কীভাবে অতিবাহিত হবে। এমন সময় অফিসের ম্যানেজার আসলে সে অতি কষ্টে দরজা খুলে অফিসারের কাছে ক্ষমা চাইতে যায়। তার এই অস্বাভাবিক শরীর দেখে ম্যানেজার সহ সবাই ভয় পেয়ে যায়। তখন তার বাবা তাকে তাড়া করলে সে রুমে ঢুকে যায় এবং ব্যথা পেয়ে আবার ঘুমিয়ে যায়।
গল্পের দ্বিতীয় অংশটিতে কাফকা গ্রেগরের সাথে পরিবারের একাত্ম হওয়ার প্রচেষ্টা দেখিয়েছেন। পরেরদিন ঘুম থেকে উঠে গ্রেগরের বোন গ্রেটা সামসার তাকে দুধ ও ডিম খেতে দেয়। তখন সে খাবারে মধ্যে স্বাদ না পেলে তাকে বাসি, নোংরা ও জুটা খাবার দিয়ে যায়। আর তাতেই সে তৃপ্তি পায়। এভাবেই অতিবাহিত হতে থাকে তাঁর দিন। এদিকে প্রতিদিন তার বোন এসে তাঁর রুম পরিষ্কারও করে দিয়ে যায়। কিন্তু সেটা তাঁর ভালো লাগে না। দেয়ালের পাশে তার পরিবারের কে কি বলে, সেগুলো শুনে শুনে সে তার সময় পার করে। তাঁর কোনো আয় রোজগার না থাকায় পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে কটু কথা বলত। যা শুনে তার খুব খারাপ লাগত। তবে তার মা তাকে দেখতে চাইতো, কিন্তু তার বাবা ও বোন দেখা করতে দিতো না এই ভেবে যে তার মা ভয় পাবে। তার চলাচলের সুবিধার জন্য ঘরের আসবাবপত্র সরানো তার ভালো লাগে না। দেয়ালে টাঙানো একটি মহিলার ছবি তার ভালো লাগতো। সেটা বাঁচাতে সে সেটার উপর লাফিয়ে ওঠে। ঠিক ঐ সময় তার মা তাকে দেখে ভয় পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। এমন সময় তার বাবা অফিস থেকে ফিরে আর তাকে আপেল ছুড়ে মারে। আপেলের আঘাতে তার পিঠ বেঁকে যায়। তখন সে খুড়িয়ে খুড়িয়ে ঘরে প্রবেশ করে।
বইটির শেষ অংশটিতে দেখানো হয় গ্রেগরের করুন মৃত্যু। দিনে দিনে সামসা তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবনতি ও দরিদ্রতা দেখতে পেলো। যতদিন যেতে থাকলো পরিবারের সবাই তার উপর বিরক্তি প্রকাশ করতে থাকলো৷ সে একই খাবার খেতে খেতে স্বাদ হারিয়ে ফেলে ছিল। ফলে সে খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলো। পরিবারে অর্থনৈতিক অবনতির কারণে তার বাবা ঘর ভাড়া দেয়। কিন্তু হঠাৎ হঠাৎ একদিন ভাড়াটিয়া গ্রেগর কে দেখে ভয় পায় এবং বাড়ি ভাড়া না দেওয়ার হুমকি দেয়। তাদের বিদায় করার পর গ্রেটা তার মা-বাবাকে বলে যে তাদের অবশ্যই গ্রেগরের থেকে মুক্তি পেতে হবে। কারণ তা না হলে গ্রেগরের জন্য তাদের সবাই ধ্বংস হবে। তার বাবাও তার সাথে একমত হল এবং আশা করল গ্রেগর তাদের অবস্থা বুঝে নিজেই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। গ্রেগর সব বুঝলো এবং তার কক্ষের মাঝে ফিরে এলো। সে সময় গ্রেগর ছিল বেশ কয়েকদিনের অনাহারী। দুঃখ, কষ্ট ও দুশ্চিন্তা নিয়ে গ্রেগর কিছুক্ষণের মাঝেই মারা গেলো। যখন তারা বুঝতে পারলো গ্রেগর মারা গিয়েছে, তখন তারা মনের মাঝে এক ধরনের মুক্তির স্বাদ পেলো। আর মারা যাওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই তারা গ্রেগরের চিন্তা তাদের মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলো।
২.
এই উপন্যাসিকাটিতে কী শুধু গ্রেগর সামসার ট্রান্সফরমেশন হয়েছে? না। তার সাথে সাথে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাঝে রুপান্তর ঘটেছে। আপনি যদি খেয়াল করেন, দেখবেন লেখক খুব সূক্ষ্মতার সাথে পরিবর্তনগুলো তুলে ধরেছেন। এখানে লেখক দুটি রুপান্তর দেখাতে চেয়েছেন। একদিকে লেখক পারিবারিক নির্ভরশীলতার রুপান্তর দেখিয়েছেন। গল্পে গ্রেগর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিল গ্রেগর সামসা। কিন্তু সে পোকায় রূপান্তরিত হওয়ার পরপরই পরিবারের বাকি তিনজনের আত্মনির্ভরশীল হয়ে মধ্যবিত্ত সংসারের চাকা ঘোরাবার এক প্রচণ্ড প্রচেষ্টা। অন্যদিকে গল্পে লেখক বিশাল এক মনস্তাত্ত্বিক চিন্তাধারার রুপান্তর ঘটিয়েছেন। যেখানে সেটা মা-বাবা ও বোন থেকে শুরু করে চিফ ক্লার্ক অবধি সবারই। নিদ্রা প্রিয়, দুশ-চিন্তাহীন বাবা, ঘরোয়া স্নেহশীলা মা ও সব থেকে কাছের প্রিয় বোন গ্রেটা কীভাবে সময়ের সাথে সাথে পাল্টে যায়, সেটা ছত্রে ছত্রে বর্ণিত হয়েছে সুন্দরভাবে। যে গ্রেগর একসময় পুরো পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল, সে গ্রেগর পোকা হয়ে যাওয়াই কেউ তাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কেউ অতীতও মনে করতে পারছে না। এমনকি তার বাবা তাকে কয়েকবার মেরেও ফেলতে চেয়েছিলো। তার অতি আদরের বোন তার বাবাকে সে জানায়- ‘এ কেবল পোকা, আমাদের পরিবারের কেউ নয়। তার জন্য আমাদের ধ্বংস হতে হবে।’ এমনকি পরিবারের দাসীকে দিয়েও তাকে তুচ্ছ করা হয়। উপন্যাসিকার শেষে যখন সবাই গ্রেগরের মৃত্যুর খবর পায়, তারা তাদের বুকে স্বস্তিতে ক্রুশচিহ্ন আঁকে।
৩.
আমরা কী ঠিক এই পোকার (গ্রেগর) মত? আমি বলবো হ্যাঁ। মেটামরফোসিস আমাদের সকলের মধ্যে ঘটে থাকে। আমরা কাউকে পরিবর্তিত হতে দেখে, অন্যরকম হতে দেখে ভাবি তারা পরিবর্তন হয়ে গেছে। তবে আমরা কখনোই এটা বুঝে উঠতে পারি না যে, আমরা নিজেরাও আর আগের মানুষ নেই। প্রকৃতপক্ষে, যারা আমাদের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে দেয়, আমরা খুব দ্রুত তাদের কৃতকর্মের কথা ভুলে যাই। ব্যক্তিস্বার্থের সামান্য ব্যাঘাত ঘটলেই আমরা কাউকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে দ্বিধাবোধ করি না। পরিবারে উপার্জনক্ষম মানুষটা যখন চাকরি হারায় বা আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়, তখন তার প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও রাতারাতি বদলে যায়। বস্তুত, পরিস্থিতির পরিবর্তন হওয়ার সাথে সাথে রূপান্তর কখনো শুধু একজন নির্দিষ্ট মানুষের মাঝে ঘটে না, তার রূপান্তরের সাথে সাথে চারপাশের মানুষেরও রূপান্তর ঘটে।
শেষ করার পূর্বে না বললেই নয়, যতদিন আপনি কিছু ভ্যালু এড করতে পারবেন, সব জায়গায় আপনার দাম থাকবে। আর যখন পারবেন না, আপন রক্তও আপনাকে চিনবে না। ‘মেটামরফোসিস’ আসলে আমাদের সবার মনের অব্যক্ত ভয় ও আশঙ্কার প্রকাশ, সেই সান্ত্বনা যা আমাদের অন্য কারও কাছে খুঁজতে যাওয়ার সাহস বা সৌভাগ্য হয়নি।
লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।