বুক রিভিউ; যদ্যপি আমার গুরু

আনিসুর রহমান

‘শিক্ষা যদি একটি সমাজের মেরুদন্ড হয় শিক্ষক হলেন সেই মেরুদণ্ডের কাশেরুকা’- ‘যদ্যপি আমার গুরু’ বইটি তার অন্যতম উদাহরণ।

“যদ্যপি আমার গুরু” মূলত গুরুর প্রতি শিষ্যের শ্রদ্ধাঞ্জলি। এই বইটি অধ্যাপক রাজ্জাকের সঙ্গে আহমদ ছফার কথাবার্তার নির্যাস। তবে একে যদি আপনি শুধু সাক্ষাৎকারধর্মী রচনা বলেন, আপনার ভুল হবে। আহমদ ছফার ভাষায়- ‘আমার এ রচনাটিকে কেউ যদি নিছক সাক্ষাৎকারধর্মী রচনা মনে করেন, আমার ধারণা, লেখাটির উপর কিঞ্চিৎ অবিচার করা হবে।’ অনেক বছর গবেষণা করার সূত্র ধরে ছফা অধ্যাপক রাজ্জাকের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন। ফলে তিনি এই বইটির পরতে পরতে রাজ্জাক স্যারের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন।

শিক্ষকদের এক অদ্ভুত ক্ষমতা থাকে। না হলে থিসিসে সহায়তা নিতে আসা আহমদ ছফাকে অধ্যাপক রাজ্জাক কি এমন জাদু করলেন যে, তিনি বইয়ের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে লাগলেন। একজন সাহিত্যের ছাত্র নতুন আবার নতুন করে বইয়ের জগতে হারিয়ে যেতে লাগলো। সত্যিই গুরুর সান্নিধ্য তার শিষ্যের জন্য আশীর্বাদই বটে।

লেখক আহমদ ছফা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুধু তার শিক্ষা গুরুর গুণগান গেয়ে গেছেন। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাককে চলমান বিশ্বকোষ বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হবে না। অর্থশাস্ত্র, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস, শিল্প-সাহিত্য, ধর্ম-সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে তার গভীর পাণ্ডিত্যের ক্ষমতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে বইটিতে। আবার তার সাথে তৎকালীন জাতীয় পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ যেমন- কবি, লেখক, পণ্ডিত, শিল্পী, রাজনীতিক, সমাজসেবক প্রমুখের সাথে কেমন সম্পর্ক ছিল তাও তুলে ধরা হয়েছে। প্রায় জনের সাথেই তিনি উঠতেন-বসতেন, আবার যাদের সাথে ওঠা-বসার সম্পর্ক ছিল না তাঁরাও বিভিন্ন সময়ে প্রফেসর রাজ্জাকের থেকে পরামর্শ নিতেন তাও অনস্বীকার্য।

প্রফেসর রাজ্জাক সবসময়ই সমাজ ও মানুষকে বুঝতে চাইতেন। এর প্রমাণ হিসেবে ছফা উল্লেখ করেছেন- রাজ্জাক স্যার কোনো দেশের মানুষকে বিচার করার ক্ষেত্রে দুটো বিষয়কে প্রাধান্য দিতে বলেছেন, ‘যখন কোনো নতুন জায়গায় যাইবেন, দুইটা বিষয় পয়লা জানার চেষ্টা করবেন। ওই জায়গার মানুষ কী খায়। আর পড়ালেখা কী করে। কাঁচাবাজারে যাইবেন, কী খায় এইডা দেখনের লাইগ্যা। আর বইয়ের দোকানে যাইবেন, পড়াশোনা কী করে, হেইডা জাননের লাইগ্যা।’

কোনো বই লেখা এবং পড়ার বিষয়েও রাজ্জাক স্যার দিয়েছেন অভিজ্ঞতালব্ধ মতামত। তার ভাষায়,“লেখার ব্যাপারটি অইল পুকুরে ঢিল ছোঁড়ার মতো ব্যাপার। যতো বড় ঢিল যত জোরে ছুঁড়বেন পাঠকের মনে, তরঙ্গটাও তত জোরে উঠব এবং অধিকক্ষণ থাকব। আর পড়ার কাজটি অইলো অন্য রকম। আপনে যখন মনে করলেন, কোন বই পইড়্যা ফেলাইলেন, নিজেরে জিগাইবেন যে-বইটা পড়ছেন, নিজের ভাষায় বইটা আবার লিখতে পারবেন কি না। আপনের ভাষার জোর লেখকের মতো শক্তিশালী না অইতে পারে, আপনার শব্দভাণ্ডার সামান্য অইতে পারে, তথাপি যদি মনে মনে আসল জিনিসটা রিপ্রোডিউস না করবার পারেন, ধইর‍্যা নিবেন, আপনের পড়া অয় নাই।”

বইটি আমার চিন্তার জগতে বিরাট একটা আলোড়ন সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে। এই বইয়ের প্রতিটি লাইন আপনাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে; আপনার চিন্তাধারায় সংযোজন করবে নতুনত্ব। “যদ্যপি আমার গুরু” পড়ার সময় আমরা যে শুধু প্রফেসর আবদুর রাজ্জাক সম্পর্কেই জানবো এমনটা নয়। খুব বেশি বড় সাইজের বই না হলেও এখানে সমসাময়িক অনেক ব্যক্তি সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে এবং প্রফেসর রাজ্জাক তাদের সম্পর্কে কেমন ধারণা রাখতেন সেটাও জানা সম্ভব হচ্ছে। লেখক অধ্যাপক রাজ্জাকের উচ্চারিত বাক্যের শুধু প্রতিধ্বনি করেননি, ব্যাখ্যা করেছেন, উপযুক্ত পরিপ্রেক্ষিতে স্থাপন করেছেন, প্রয়োজনে প্রতিবাদও করেছেন। এই যেমন ধরেন, প্রফেসর রাজ্জাক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, পল্লী কবি জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী প্রমুখ ব্যক্তিদের অকুণ্ঠচিত্তে প্রশংসা করলেও অন্যদের ক্ষেত্রে কিছুটা ‘যদি-কিন্তু’ এঁকে দিয়েছেন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সাহিত্যকর্মকে প্রফেসর রাজ্জাক আধুনিক ঠিকই মনে করতেন, কিন্তু সেগুলো তাঁর মতে মধ্যযুগীয় ধর্ম কেন্দ্রিক ছিল। আবার রাজা রামমোহন রায়কেও তিনি বড়ো কোনো সমাজ সংস্কারক বলে রায় দেননি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যত বড় লেখক ছিলেন, ততো বড়ো ছিলেন না বলে তিনি মনে করতেন। তিনি প্রশংসা করেছেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এবং শিল্পী এস এম সুলতান। আবার তিনি ইংরেজ কবি উইলিয়াম শেকসপিয়ারের প্রশংসা করেছেন উৎফুল্লতার সহিত।

কেন এই বইটি পড়া উচিত? যদি এই প্রশ্ন করা হয় তার প্রতিউত্তরে আমি কয়েকটি পয়েন্ট তুলে ধরবো। যেমন-

*প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক সম্পর্কে জানতে পারবেন। যিনি চারটি প্রজন্মের তরুণদের শিক্ষা দিয়েছেন।

*এই বইটি পড়ার মাধ্যমে আপনি একই সঙ্গে অনেকগুলো বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন।

*এই বইটি পড়ার মাধ্যমে আপনি একটি এলিট সমাজে প্রবেশ করার অভিজ্ঞতা লাভ করবেন।

*সর্বশেষ কিছু জানুন আর না জানুন, একগাদা বই এবং বিভিন্ন লেখকের নাম জানতে পারবেন।

শেষ করবো বইয়ের একটি লাইন দিয়ে, “জ্ঞানবিজ্ঞান ব্যক্তির সাধনায় বিকশিত হয়, কিন্তু সমাজের মাঝে জ্ঞানের প্রয়োজন অনুভূত হওয়া চাই”।

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। 

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version