কেন বিলুপ্তির পথে তক্ষক?

নাঈমুর রহমান রিজভী:

তক্ষকের কথা আমরা লোকমুখে সবাই শুনেছি। তক্ষক বিক্রি করে কোটিপতি হওয়া যায়, এই গল্প শুনেনি এমন মানুষ পাওয়াও দুরূহ ব্যাপার। আর এই কোটিপতি হওয়ার স্বপ্ন থেকেই অনেকে এই প্রাণী শিকার করে থাকেন। কিন্তু আসলেই কি এই প্রাণীর দাম কোটি টাকা? কী কাজেই বা লাগে এই প্রাণী? কারা এই প্রাণী সংরক্ষণ করছেন ? এই প্রশ্নগুলোর ব্যাখ্যা জানে না অনেকেই। তবে লোকমুখে প্রচলিত আছে, মরণব্যাধি ক্যান্সারের প্রতিষেধক তৈরিতে এই প্রাণীকে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু এর কোনো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। কিন্তু এই কথা মানতে নারাজ তক্ষক শিকারিরা। সব বাঁধাকে অগ্রাহ্য করে তারা অবাধে শিকার করছে নিরীহ এই প্রাণীটি। ফলে এটি আজ বিলুপ্তির পথে।

তক্ষক একটি সরীসৃপ প্রাণী। এরা দলবদ্ধভাবে ঝোপঝাড়, গাছপালা, বাড়ির ছাদের ভাঙা ফাঁক-ফোঁকড় বা গর্তে বাস করে। এদেরকে ইংরেজিতে South Asian Giant House Gecko এবং বিজ্ঞানের ভাষায় Gekko Gecko বলে। তক্ষক দেখতে ধূসর, নীলচে-ধূসর বা বেগুনি ধূসর বর্ণের। এদের শরীরে লাল ও সাদা ধূসর ফোঁটা থাকে। এদের ডাক অনেক স্পষ্ট এবং কক্ কক্ আওয়াজে শুরু হয়। অতঃপর স্পষ্ট স্বরে কয়েকবার তক্-ক্কা ডাকে। নিশাচর এই প্রাণীটির দেহ প্রায় ৩২ সেন্টিমিটার দীর্ঘ হয়ে থাকে। পতঙ্গ, ফড়িং, গুবরে পোকা, উইপোকা, ঝিঁঝি পোকা, তেলাপোকা, মশা এবং মাকড়সাসহ অমেরুদণ্ডী প্রাণীদের শিকার করে তারা বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য বজায় রাখে। এরা মানুষের কোনো ক্ষতি করে না। বরং এরা পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় ভূমিকা রাখে।

আমাদের দেশে প্রায় দুই প্রজাতির তক্ষক দেখা যায়। বাংলাদেশের পাশাপাশি মায়ানমার, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, লাওস, কাম্পুচিয়া, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, চীন ও ফিলিপাইনসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৬০০ প্রজাতির তক্ষকের বসবাস রয়েছে।

তক্ষকরা সাধারণত খুব দুরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে থাকে। এরা মানুষের চেয়ে ৩৫০ গুণ দৃষ্টিসম্পন্ন। এটির লেজ, দাঁত, পা প্রভৃতি কোনোভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেও তা আবার প্রাকৃতিকভাবে গজাতে পারে।

বহুল প্রচলিত একটি গুজব রয়েছে যে একটি তক্ষকের মূল্য কোটি টাকা। এই প্রাণী এইডস এবং ক্যান্সার নিরাময় করতে পারে। যদিও ২০১৩ সালের একটি সমীক্ষায় তক্ষক এইচআইভি/এইডস নিরাময়ের দাবিকে সমর্থন করার জন্য কোনও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ খুঁজে পায়নি। তবুও তক্ষক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবাধে পাচার ও উচ্চমূল্যে বিক্রি হচ্ছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন-২০১২ অনুসারে, বন্য তক্ষকের ব্যবসা এবং বিক্রয় একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। বাংলাদেশ বন বিভাগের তথ্যমতে, ২০২২ সালে সারাদেশ থেকে প্রায় এক ডজন তক্ষক উদ্ধার করা হয়েছিল এবং ১৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তবে প্রতি বছর কতটি তক্ষক পাচার হচ্ছে তা নিশ্চিত করতে পারেনি সূত্রটি।

একটি গবেষণায় দেখা গেছে, শত শত বছর আগে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ঐতিহ্যবাহী ওষুধে এই প্রাণীর ব্যবহার করা হয়েছে। চীনা ওষুধে ফুসফুস এবং কিডনিকে শক্তিশালী করতে এবং ত্বকের রোগ, হাঁপানি, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। ভিয়েতনামে এই প্রাণীর নির্যাস ইরেক্টাইল ডিসফাংশন এবং ক্রমাগত কাশির চিকিৎসার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু অংশে শক্তি এবং জীবনীশক্তি বাড়াতে এবং কামোদ্দীপক বা শক্তি পানীয় হিসাবে এ প্রাণীদের ওয়াইন বা হুইস্কি খাওয়া হয়। ওষুধের পাশাপাশি তক্ষক অনেক দেশে পোষা প্রাণী হিসেবে বিক্রি করা হয়। পাশাপাশি পূর্ব এশিয়া ও আশেপাশের অঞ্চলে তক্ষকের উচ্চ চাহিদা রয়েছে এবং সে কারণেই সরীসৃপ প্রজাতিটি এই দেশগুলিতে পাচার করা হচ্ছে। তক্ষকের এই অতিমাত্রায় শিকারের ফলে সরীসৃপ এই প্রাণীটি আজ বিলুপ্তির পথে।

তক্ষক একটি দরকারি প্রাণী। এটি পোকামাকড় খেয়ে প্রকৃতির ভারসাম্য বজায় রাখে। তাই আমাদের উচিত এই প্রাণীটি শিকারে বিরত থাকা। যদি তক্ষক শিকার এবং এর বাসস্থান ধ্বংস অব্যাহত থাকে তাহলে শেষ পর্যন্ত এই প্রাণীটি পৃথিবী থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে।

লেখক: শিক্ষার্থী, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version