চাকরি স্থায়ী করতে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ গবেষক

শিপন তালুকদার

“২০১২ সালে যখন আমি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি, তখন আমার কোন গবেষণাপত্র নেই। চাকরির একবছর হয়ে যাওয়ার পরও চাকরি স্থায়ী হচ্ছিলো না গবেষণাপত্রের অভাবে। অনেক শিক্ষকের সাথে গবেষণার কাজ করতে চেয়েছি, কিন্তু কেউই আমাকে সাথে নেয়নি। তখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে নিজ থেকেই জিদ করে বসি, গবেষণা কি আমি দেখে নিব।” এমনটাই বলছিলেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক, জীব ও ভূবিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. আবু রেজা মো. তৌফিকুল ইসলাম। যিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে একবার শ্রেষ্ঠ গবেষক পুরষ্কারও অর্জন করেছেন।

তিনি বলেন, শিক্ষকতার বাইরে পুরো সময়টা গবেষণায় ব্যয় করছি। আমার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনায় রয়েছে গবেষণা, তাই করোনাকালে দৈনিক ১৮ ঘণ্টা গবেষণায় শ্রম দিয়েছিলাম, যার ফলাফল এখন পাচ্ছি।

শুরুতে গবেষণার কাজটি আমার কাছে এতো সহজ ছিলো না। দিন-রাত এক করে গবেষণার পিছনে ব্যয় করতে থাকি। অনেক পরিশ্রম করে গবেষণা পত্র তৈরি করে আন্তর্জাতিক জার্নালে পাবলিশ করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু ব্যর্থ হই। হাই ইম্প্যাক্ট জার্নাল, স্প্রিঞ্জার জার্নাল সহ একাধিক জার্নাল থেকেও আমার গবেষণা পত্র বাতিল হতে থাকে। আমিও হাল ছাড়ি না। এভাবে গবেষণা পত্র বাতিল হতে হতে একসময় পাবলিশ করতে সমর্থ হই। এরপর একে একে ৫/৬ টি গবেষণা পেপার পাবলিশ হয়। তখন আমার গবেষণার প্রতি আগ্রহ বাড়ে। শুরুতে ভালো কোন জার্নালে আমার গবেষণা প্রকাশিত না হলেও ২/১ কোয়ালিটি সম্পন্ন গবেষণাপত্র থাকায় চাইনিজ গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ পাই। এরপর চীনে গিয়ে দেখি গবেষণার সমুদ্রে এসেছি। চীনে গবেষণার ব্যাপক সুযোগ ও গবেষণার সামগ্রী হাতের নাগালে থাকায় আমিও গবেষণায় মনোযোগী হয়। নতুন করে গবেষণায় অনুপ্রেরণা পাই। এরপর থেকেই বিশ্বসেরা জার্নালগুলোতে আমার গবেষণাপত্র প্রকাশিত হতে থাকে।

২০১৭ সালে পিএইচডি করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আসি তখনও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তেমন গবেষণার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। কয়েক বছরের পরিশ্রমে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগে গবেষণার সংস্কৃতি তৈরি করতে চেষ্টা করি। বর্তমানে এ বিভাগে শিক্ষকদের পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও গবেষণায় মনোযোগী হচ্ছেন। আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন পর্তুগাল, স্পেন, আমেরিকা সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে।

করোনাকালীন সময় গবেষকের জন্য আশির্বাদ স্বরুপ ছিলো বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজের চাপ না থাকায় গবেষণায় সময় দিতে পেরেছি। খাওয়া, ঘুম ব্যতীত দিনে ১৮ ঘণ্টা গবেষণায় ব্যয় করেছি। সারা বিশ্বের মানুষ যখন করোনা মহামারিতে আতঙ্কিত, আমি তখন মানুষের সমস্যা সমাধানে ও মানব কল্যাণে সময় ব্যয় করেছি। এ সময় আমি চীন, ভারত, সৌদি আরব, ব্রাজিল, আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশের গবেষকদের সাথে গ্রুপ ভিত্তিক কাজ করেছি। প্রতি ৭ দিনে ১ টি করে আর্টিকেল প্রকাশ হতো। এখন বুয়েট, পটুয়াখালি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন দেশের গবেষকদের সাথে সমন্বয়ে কাজ করছি। এখন আমার গুগল স্কলার সাইটেশন ৬৪০০।

আমার ইচ্ছা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের গবেষণার জন্য উৎসাহিত করা এবং এ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ তৈরি করা। যাতে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দ্বারা দেশ ও জাতি উপকৃত হতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন জার্নালের এক্সেস ও ফান্ডের এক্সেস এবং বুনিয়াদি গবেষক ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা।

নতুন গবেষকদের উদ্দেশ্যে করে তিনি বলেন, হতাশ হওয়া যাবে না। আর গবেষণা চালিয়ে যেতে হবে। গবেষণার প্রতি প্যাশন থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন আমি অনুরোধ জানাবো গার্বেজ জার্নালে যেন গবেষণা প্রকাশ না করা হয় এতে খ্যাতি নষ্ট হয়।

প্রসঙ্গত, ড. আবু রেজা মো. তৌফিকুল ইসলাম চীনের নানঞ্জিং তথ্য বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০১৭ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। পানি সম্পদের উপর জলবায়ুর প্রভাব বিষয়ে গবেষণার জন্য তাকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হয়। তিনি দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, খরা, বন্যা, আবহাওয়া ও জলবায়ু নিয়ে গবেষণা করে থাকেন। বিশ্বসেরা ২ শতাংশ গবেষকদের তালিকায় তার নামও রয়েছে। তিনি ২০২০ সালে বাংলাদেশ একাডেমি অফ সাইন্সেস এর সহযোগী ফেলো নির্বাচিত হয়েছেন। সম্প্রতি থাইল্যান্ডের প্রিন্স অফ সংঙ্কলা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

লেখক: শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়,

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version