আবু শামা:
সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা আমার সোনার বাংলা। সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টির এক অনন্য নিদর্শন এই নদীমাতৃক বাংলা। বাংলার বিভিন্ন জনপদ গড়ে উঠেছে নদ-নদীর উপর নির্ভর করে। এসকল জনপদ কিংবা আবাসস্থল গুলো সৃষ্টির আদিকাল থেকেই যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল নদীকে কেন্দ্র করে। যেভাবে মিশরীয় সভ্যতা গড়ে উঠেছিল নীল নদকে কেন্দ্র করে, সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল সিন্ধু নদের অববাহিকায়। যেমনি মুঘল সাম্রাজ্যের অধিপতি জাহাঙ্গীর ঢাকা শহরকে গড়ে তুলছিলেন বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। তেমনি মাতামুহুরিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে, বান্দরবান,আলীকদম, লামা, চকরিয়া, ও পেকুয়ার অংশবিশেষ।
মাতামুহুরির উৎপত্তি নিয়ে বির্তক আছে, কারও মতে বান্দরবানের মাইভর পর্বত থেকে নদীটির উৎপত্তি, আবার কেউ বলেন এর উৎপত্তি আরাকানের লুসাই পাহাড়। মাতামুহুরি নামেরও একটা সুন্দর ইতিহাস রয়েছে। মগ ভাষায় এই নদীটির নাম মামুরি। জনশ্রুতি আছে এই নদী নাকি কোন একটি একক উৎস (নির্দিষ্ট ঝরণা) হতে সৃষ্টি নয়। এতে মাতৃস্তন সদৃশ বিভিন্ন পর্বত গাত্র হতে জল চুয়ে চুয়ে পড়েই নদীর সৃষ্টি। তাই এর নাম মাতামুহুরী। মুহুরী শব্দের অর্থ অসংখ্য ছিদ্র দিয়ে জলপড়া ঝাজর। এই নদী চকরিয়ার বুকচিরে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। নদীটির মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮৭ কিলোমিটার, বাংলাদেশ অংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৫৪ মিটার। বঙ্গোপসাগরে মাতামুহুরির মোহনায় যে বদ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে তা চকরিয়া খুটাখালির ভোলা খাল পর্যন্ত বিস্তৃত। বদ্বীপটি সুন্দরবনের বৈশিষ্ট্যধারী এবং জালের মতো ছড়ানো খাঁড়ি আর গরান বনের আচ্ছাদনসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গঠিত।
শত-সহস্র বর্ষের ঐতিহ্যের ধারক-বাহক প্রবাহিণী মাতামুহুরীর পাশে গড়ে ওঠা জনপদে সুদূর প্রাচীনকালে গড়ে উঠেছিল সভ্যতা। এ নদীর অববাহিকাকে ঘিরে গড়ে উঠে জনবসতি। নদীর পানি সিঞ্চনে প্রতিবছর আবর্তিত হয় কৃষি অর্থনীতি। ফলে এ নদীর উদারতা পাহাড়ি জনপদ আলীকদম-লামা ও সমতলের চকরিয়া উপজেলাকে দিয়েছে নান্দনিক বৈভব। এ যেন মহান স্রষ্টার অতুলনীয় সৃষ্টি ও ঐশ্বর্য।
মাতামুহুরির তীরে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন প্রায় লাখো মানুষ। আর শীতকালীন সময়ে চাষীরা প্রায় ৫কোটি টাকা অর্থমূল্যের বিভিন্ন খাদ্যশস্য যোগান দিয়ে থাকেন এই নদীকে কেন্দ্র করে। এছাড়াও নদীতে মাছ আহরণ করে জীবন নির্বাহ করেন হাজার দশেক জেলে। এ নদীর তীরেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশের শতকোটি টাকার রপ্তানিযোগ্য পণ্য গলদা চিংড়ির চাষ ও মৎস্য খামার। এছাড়াও লবণ চাষের জন্যে বঙ্গোপসাগরকে কেন্দ্র করে ছোট ছোট খাল তৈরী করে মাতামুহুরি নদীর সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে। সেখানেও লবণ চাষে আয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ।
মাতামুহুরী নদীর উপর তৈরী হয়েছে ছোট বড় ৪ থেকে ৫ টি সেতু। বর্তমানে পর্যটন নগরী কক্সবাজারের প্রবেশদ্বার চকরিয়ায় তৈরী হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন মাতামুহুরি সেতু। এছাড়াও রয়েছে, বেতুয়া বাজার ব্রিজ, বাটাখালি ব্রিজ, মানিকপুর-সুরাজপুর ব্রিজ এবং বাংলাদেশের একমাত্র পাহাড়ি দ্বীপ মহেশখালিকে সংযুক্তিকরণ বদরখালী ব্রিজ। রয়েছে গোবিন্দপুর রেলসেতু। এসকল ব্রিজ বিভিন্নভাবে দেশের অর্থনৈতিক চাকাকে সচল করেছে।
মাতামুহুরি পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম নদী। কিন্তু বর্তমানে মাতামুহুরি তার আগের রুপ হারিয়ে ফেলেছে। প্রায় দুইযুগ আগেও স্রোতোবহা মাতামুহুরী সম্পদ-সম্ভারে ছিল পরিপূর্ণ। দেখা যেত লম্বা লম্বা বাঁশের ভুর, লঞ্চ, ট্রলারসহ ছোট ছোট নৌকা। তারুণ্যের উদ্বেলতা ছিল এ সমুদ্রকান্তার প্রবাহে। জল জীববৈচিত্রের বিপুল সম্ভারে ছিল পরিপূর্ণ। নদীর কিছুদূর পর পর ছিল তীব্র স্রোত। যাকে স্থানীয়রা ‘দরদরি’ হিসেবে চিহ্নিত করতো। কিন্তু বর্তমানে নদীটির স্বাভাবিক অবস্থা আর নেই। দীর্ঘ দুইযুগের বেশি সময় ধরে নদীর তীরে তামাক চাষ ও বৃক্ষ নিধনে পরিবেশ হয়েছে বিপর্যস্ত। প্রতিবছর পাহাড়ি জুমিয়াদের জুমচাষ নদী তরীবর্তী সবুজাভ পাহাড়গুলোতে বয়ে আনে শ্মশানের ছাইয়ের ধূসরতা।
আবার এই খরস্রোতা নদী বর্ষায় ভয়ংকর রুপ ধারণ করে তার বুকে বিলিয়ে নিয়ে যায় হাজারো মানুষের স্বপ্ন। ভিটেমাটি ছেড়ে নিঃস্ব হয় শতশত মানুষ। এছাড়াও প্রবলভাবে ভাঙ্গন ধরেছে নদীর পাড়। যার কারণে নির্মিত ব্রিজ গুলো আজ হুমকির মুখে। এসবের কারণ হিসাবে দেখা হচ্ছে নদীর নাব্যতা হারিয়ে যাওয়া, নদীর উৎপত্তি স্থলে জুম চাষ, পাহাড় কাটা, গাছাপালা নিধন। বন্যার সময় উজান থেকে নেমে আসা মাটির কারণে নদী ভরাট হয়ে গেছে। এছাড়াও অবৈধভাবে উত্তলন করা হচ্ছে বালু। অপরিকল্পিত এবং মাত্রাতিরিক্ত বালু উত্তলন করার কারণে নদীর পাড়গুলোও এখন হুমকির মুখে।
সাম্প্রতিক সময়ে একটি জরিপে দেখা যায়, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন ব্যাক্তিদের তত্ত্বাবধানে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। চকরিয়ায় বর্তমানে ১৪টি পয়েন্টে অন্তত ২০ লাখ ঘনফুট বালু মজুত আছে। প্রতি ট্রাক বালু বিক্রি হচ্ছে ৩৩০ থেকে ৭০০ টাকায়। সরকারি হিসাবে প্রতি ঘনফুট বালুতে রাজস্ব দিতে হয় ৩৫ টাকা। এ হিসাবে ২০ লাখ ঘনফুট বালুতে সরকারের ৭ কোটি টাকা রাজস্ব পাওয়ার কথা। কিন্তু অননুমোদিত এবং অবৈধ উত্তোলনের ফলে একদিকে যেমন সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে আবার অতিরিক্ত বালু উত্তোলনের কারনে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে।
আগে মাতামুহুরীর বাঁকে বাঁকে ছিল কাজল কালো জল। এ জলাধারগুলোকে স্থানীয়রা ‘কুম’ হিসেবে চিনতো। এখন আর সেই গভীরতা নেই। নদীর পাড়ের সুবিন্যস্ত সবুজাভ সজ্জা নেই। হেমন্তে কাশফুলের উদ্যামতাও দেখা যায় না। তাই হারিয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্য, মানুষ হারাচ্ছে ফসলের মাঠ, স্থবির হয়ে যাচ্ছে অর্থনীতির চাকা। নদীর পাড়াগুলো রক্ষার জন্যেও নেই তেমন কোন সরকারি উদ্যোগ।
তাই এই বিস্তীর্ণ জনপদ এবং প্রকৃতির সবুজাভ অনুপম অনুভব করতে হলে মাতামুহুরীর অবদানকে কোনভাবে অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের উদ্যোগী হওয়ার সময়ও ফুরিয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। তাই আসুন সবাই সচেতন হই। আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে সদা প্রস্তুত থাকি। নান্দনিক মাতামুহুরীকে মায়ের মতোই ভালোবাসি। আসুন নদীর খেয়াল রাখি এবং অর্থনীতি সচল করি।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।