চাঁদের বুড়ির সুতো: শৈশবের রঙিন স্মৃতি

জুবায়ের রহমান:

ঋতুচক্রে আমাদের এখন বর্ষাকাল। বর্ষার চিরচেনা রুপে হঠাৎই নেমে আসে মুষলধারের বৃষ্টি। আবার কখনওবা সেই বৃষ্টির মাঝেই গগন আলোকিত করে রোদ ঝলমলিয়ে উঠতে খুব সময় অতিবাহিত হয়না। এটি আমার দেশের প্রাকৃতিক রূপের চিরাচরিত বহিঃপ্রকাশ। এদিকে বেলা পেরোলেই পশ্চিমের নরম রোদ এখনই জানান দিচ্ছে অথৈই পানি ও কাশফুলের ঋতু শরতের।

স্বভাবতই শরতের নীল আকাশে খেলা করে সাদা মেঘের ভেলা। কাশফুল, পরিষ্কার নীল আকাশ আর সবুজ মাঠ৷ শব্দগুলো শুনলেই আমাদের মনে ঋতুর রানি শরতের ঝলমলে আলো দোলা দিয়ে যায়৷

তবে সেই সাদা শুভ্র বিস্তীর্ণ মাঠের পরে তখন ঘুড়ির সুতোর মত সাদা আঁশ আকাশে উড়তে দেখা যায়। ছেলেবেলায় যাদের গ্রামীণ জীবনের স্মৃতি এখনও আলতো অনুভূতির আবরণ দিয়ে যায়, মাঠের পর মাঠ পেরিয়ে সেই সাদা আঁশটে সুতো বস্তু সংগ্রহই ছিলো সেই দুরন্ত শৈশবের দারূণ অনুভূতি। তবে ঋতুভেদে গ্রীষ্ম, বর্ষায়ও দেখা যায় এসব সুতো।

সেসময় আমাদের মায়েরা এসব সাদা আঁশ নিয়ে রুপকথার গল্প জুড়ে দিতো। একেকজন একেকভাবে সেসব সুতোর ব্যাখা দিতো। তখন সবার মুখে মুখে কথার জুড়ি বসত এসব সাদা আশ নিয়ে। যারা দৈহিক গড়নে একটু বড় কিংবা ভালো দৌড়াতে পারে তারাই কেবল অন্যদের ডিঙ্গিয়ে এসব সাদা আশ বা তথাকথিত বুড়ির সুতো বেশি সংগ্রহ করতে পারত।

অত্যধিক গরমের কারণে অনেকেই এসময়ে তখন মাথার চুল কেটে ফেলত। গ্রামাঞ্চলে মূলত শিশু-কিশোরদের চুল কেটে ফেলা হতো তখন। গ্রামাঞ্চলে একটি ধারণা ছিলো এইরকম যে, বেল মাথায় চাঁদের বুড়ির সুতো দিয়ে রাখলে চুল তাড়াতাড়ি গজায়। চুল হয়ে উঠে ঘনকালো।

ছোটবেলায় সবাই বলত চাঁদে একটি বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে থাকে এক বুড়ি। যার বিশেষ কোন কাজ নেই। সারাদিন চরকায় সুতো কাঁটত আর জাল বুনত। সেখানের ফেলে দেওয়া সুতো পৃথিবীতে ছেড়ে দিতো বুড়ি।

আবার অনেকে বলত চাঁদের বুড়ি দিনে ঘুমায়। আর রাতে চরকা ঘুরায়। চরকা ঘুরিয়ে সুতো পেঁচায়। সুতো ছিঁড়ে যায়! চাঁদের বুড়ির মন খারাপ হয়। ছিঁড়ে যাওয়া সুতো চাঁদের বুড়ি উড়িয়ে দেয়। সুতো নেমে আসে নিচে।

তবে সেই সব লোকগল্পের সমাপ্তি এখানেই শেষ নয়। অনেকেই এগুলোকে কাশফুল বা শিমুল গাছের তুলা ভাবত তখন।

তবে এগুলো তুলো কিংবা কাঁশফুল নয়। রুপকথার গল্পের চাঁদের বুড়ির চরকির সুতাও নয়। এগুলো হলো Chemwebs। যাকে মাকড়সার সিল্ক বলে থাকে। মাকড়সা নিজেদের চলাচল, আহারাদি বা শিকারের করার উদ্দেশ্যে সিল্কের জাল বুনে। মাকড়সার উদরে অবস্থিত রেচনত্যাগী গ্রন্থি থেকে এই সুতার জন্ম হয়। এদের সিল্ক গ্ল্যান্ড বলা হয়। মাকড়সার জালে এক ধরনের চটচটে স্থিতিস্থাপক ভাব থাকে।

আবার আকাশে দলা দলা যে সুতার মতো বস্তুগুলো দেখা যায় তা একটি মাকড়সার তৈরি নয়। কয়েকশত বা কয়েক হাজার মাকড়সার তৈরি সিল্ক এর জাল একত্রে এগুলো তৈরি হয়।

সাম্প্রতিক সময়ে মাকড়সার সিল্ক থেকে বিশ্বের উন্নত মানের সিল্কগুলোর মধ্যে অন্যতম। গবেষকদের গবেষণায় উঠে এসেছে এমনই কিছু তথ্য।

উষ্ণপ্রধান অঞ্চলে একজাতের স্ত্রী মাকড়সা হয়, যা প্রায় শিশুদের গলায় ঝুলানো করের সমান। সে তার প্রতিবেশী পুরুষ মাকড়সাদের (তুলনায় ছোট ও দুর্বল) ধীরে ধীরে গিলে ফেলে। তারপর তারা এক অনন্য ধর্মী সোনালী রঙের সিল্ক তৈরি করে। যা এ পৃথিবীতে দুর্মূল্য।

সারা বিশ্বে যত শক্তিশালী সিল্ক রয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী সিল্ক হল এই প্রজাতির মাকড়সার জাল থেকে তৈরি হওয়া সিল্ক। এতোটাই কঠিন প্রায় স্টিলের মতোই শক্ত। এমনকি এই সিল্ক দিয়ে এমন বর্মও বানানো যায় যা বুলেটেরও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

এই সিল্ক থেকে তৈরি হওয়া কাপড় জন্ম নেওয়ার কাহিনীও বেশ রোমাঞ্চকর। গেল বছরই এমনই মাকড়সার সিল্ক থেকে প্রস্তুত করা কাপড়ের প্রদর্শনী হয়েছিল লন্ডনে। কাপড়ের ডিজাইনারের দাবি , প্রায় আট বছর ধরে ২০ লক্ষ মাকড়সার বিশেষ ধর্মী জাল সংগ্রাহ করে, সেটিকে প্রোসেস করে কাপড় প্রস্তুত করা হয়েছে।

লেখক: শিক্ষার্থী, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version