মুসলিম বিশ্বের একমাত্র আন্তর্জাতিক মিডিয়ার রূপকার

মোঃ সায়েম মুহাইমেন
আজকে আপনাদের ওয়াদ্দাহ খানফারের গল্প শোনাবো। খানফার রামায় জন্ম নেওয়া ফিলিস্তিনি যার হাত ধরে আর ১০ টা সাধারণ নিউজ চ্যানেল থেকে আল জাজিরা একটি আন্তর্জাতিক মানের নিউজ চ্যানেলে পরিণত হয়েছিল। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী খানফার বৈচিত্রময় শিক্ষা জীবনের শুরুতে খানফার জর্ডান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে BSc (Engg) শেষ করেন। অতঃপর সুদান পাড়ি জমান। সুদান আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে মাস্টার্স এবং দক্ষিণ আফ্রিকা বিষয়ে একটি ডিপ্লোমাও করেন। এত কিছুর পরও যেন তাঁর তৃষ্ণা মিটলো না। সর্বশেষ সুদান আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে International Politics এ গ্রাজুয়েশন করার মধ্য দিয়ে শিক্ষা জীবনের পাঠ চুকালেন।
ছাত্র জীবনেই খানফার নিজে একটি ছাত্র সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। খুব দ্রুত তার Student Union আরে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে পড়ে আর খানফারও বেশ পরিচিতি লাভ করেন।
পশ্চিম তীরের জেনিনে খানফার এবং তাঁর ৭ ভাই-বোনের বেড়ে উঠা। বাবা পেশায় শিক্ষক। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং-এ পড়ার নেশা খানফারকে বিচ্ছিন্ন করে জর্ডানে নিয়ে আসে। জর্ডান ইউনির স্টুডেন্ট ইউনিয়নে একদিন একটি মেয়ে বক্তব্য দিচ্ছিল। সাহিত্য-ই তার ধ্যান জ্ঞান। কিন্তু গলায় বেশ তেজ, মেয়েটির দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্বে খানফার মুগ্ধ। সেমিনার শেষেই বিয়ের প্রস্তাব করে বসেন।খানফারের জবানিতে “A very beautiful, simple, isolated life”
বৈচিত্র্যে ভরপুর খানফার চেয়েছিলেন কোন থিংক ট্যাংকের গবেষক হবেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় গবেষণা শুরুও করেছিলেন। তাঁর ব্যাচেলরের থিসিসও ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার উপর। কিন্তু আল্লাহর পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। ২০০১ সালে আল জাজিরা খানফারের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা বিষয়ে একটি এনালাইসিস চায়। সেই সূত্র ধরে খানফারের আল-জাজিরার দক্ষিণ আফ্রিকা করোসপডেন্ট হওয়া। সেখান থেকে ৯/১১ পরবর্তী আফগান যুদ্ধ কাভার করতে যান আফগানিস্তানে। কিছুদিন আফগানিস্তানে অবস্থানের পর তালেবানের বিরোধে ফলে নয়াদিল্লিতে স্থানান্তরিত হন। এর মাঝে আফগান ব্যুরোর প্রধানকে নিয়ে আভ্যন্তরীণ সমস্যা তৈরি হলে খানফার তার স্থলাভিষিক্ত হন। সেখান থেকে ছুটে যান ইরাকে। ইরাক – আমেরিকা যুদ্ধে খানফার উত্তর ইরাকের কুর্দিস্তানে অবস্থান করেন। এভাবে বিভিন্ন ঘটনা পরম্পরায় খানফার তার যোগ্যতার প্রমাণ দিতে থাকেন। ফলাফল মাত্র ২ বছরে অর্থাৎ ২০০৩-এ খানফার আল জাজিরার ব্যবস্থাপনা পরিচালকে পরিণত হন। ২০০৬ সালে আল-জাজিরা তাকে General Director পদে আসীন করে।
২০০৬ এ খানফার General Director হওয়ার আগ পর্যন্ত আল-জাজিরা তখনো লোকাল নিউজ চ্যানেলই ছিল। কিন্তু খানফারের global mindset আল জাজিরাকে কয়েক বছরের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে পরিণত করেছে। খানফার বিশ্বাস করেন “The newsroom is there to filter, to make order. The reporter is much more free, closer to the people and full of excitement.”। খানফার তার সময়ে আল- জাজিরার আন্তর্জাতিক ব্যুরোর সংখ্যা ৭২ এ উন্নীত করেন।
কিন্তু মিডিয়ার জগত ততোটা স্বাধীন নয় যতটা দেখে মনে হয়। আরব বসন্তকে বসন্তে রূপ দানে খানফার এবং আল-জাজিরার ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ২০১১ সালে মিশরের হোসনি মোবারক আল-জাজিরাকে নিষিদ্ধ করে এবং সকল প্রকারের ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ করে। কিন্তু এর মাঝেও আল জাজিরা তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যায়। বলা যায় আল জাজিরার মিডিয়া এক্টিভিটি মিশরের গণমানুষকে রাস্তায় নেমে আসতে সাহায্য করে। খানফার বিষয়টিকে এভাবে ব্যাখ্যা করেন, “When you are telling people for 15 years that they have the right to express their opinion, I think that will definitely, in their back-mind, create a new atmosphere.”
বাংলাদেশে আমরা ২০২৪ শে যে চিত্র দেখেছি ২০১১ তে সেই ঘটনার প্রথম সাক্ষী আল-জাজিরা। অবশ্য বাংলাদেশেও আল-জাজিরা একই পদক্ষেপ নিয়েছে। আল-জাজিরার জন্য এধরণের পরিস্থিতি নতুন না। খানফারের জবানিতেই শুনি, “Without people, internet activists, we would never have been able continuously to cover the revolutions, we would have had no footage. That is why I always say, may God bless the ones who decided to put a camera in a cellphone. If you see the coverage of Syria, for example, almost every single image we broadcast came from mobile phones. That was a moment when media liberated itself from state control and people stood fast to support us.”
তিউনিশা, মিশর, সিরিয়া, লিবিয়া সর্বত্র আরবের শাসকদের উৎখাত; আরবের অপরাপর রাজ পরিবারগুলোকে বিচলিত করে তুলে। আর এর প্রভাব আল জাজিরার উপর পড়তেও খুব বেশি সময় নেয়নি। গালফের ছোট্ট দেশ কাতারের জন্য এই পরিস্থিতি ছিল খুবই অস্বস্তিকর। একদিকে সৌদি,আমিরাতসহ গালফের রাজ পরিবারগুলো উঠে পড়ে লাগে। অন্যদিকে মরার উপর খাঁড়ার ঘাঁ হয়ে দাঁড়ায় আমেরিকার একের পর WikiLeaks এর মাধ্যমে খানফারকে টার্গেট করা। সবমিলিয়ে সমীকরণ ক্রমশই জটিলতর হয়ে উঠে।
অবশেষে খানফার তাঁর প্রতিষ্ঠানের জন্য নিজের পদ-পদবী সেক্রিফাইজ করলেন। ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১১ সালে সরে দাঁড়ালেন। আর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন কাতারের যুবরাজ আহমেদ বিন জাসিম আল থানি। বলা যায় আল জাজিরাকে টিকিয়ে রাখতেই এত উচ্চ পর্যায় থেকে খানফারের উত্তরসূরী নিয়োগ দিতে হয়েছে।
খানফার যখন আল জাজিরায় যোগদান করেন তখন তার বয়স ছিল ৩৩ আর যখন আল জাজিরাকে একটি আন্তর্জাতিক মিডিয়া হিসেবে স্টাবলিজ শেষে, একটি বসন্তের সূচনা করে বিদায় নেন তখন তার বয়স ৪৩।
২০০৯ এ ফোবস ম্যাগাজিন খানফারকে বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ জন ব্যক্তির মাঝে স্থান দেয়। রহস্যজনক ভাবে এখন পর্যন্ত ফোবস যাকেই প্রভাবশালী বলেছে সেই বছরান্তে তার পদ হারিয়েছে। বাংলাদেশের সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া এবং শেখ হাসিনার নাম ফোবসের ১০০ প্রভাবশালীর তালিকায় আসার কিছুদিন পরই পদচ্যুত হন।
সে যাই হোক বর্তমানে খানফার আল সারক ফোরামের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আল সারক একটি স্ট্যাটেজিক প্লাটফর্ম। বলতে পারেন তরুণ বয়সে খানফার যে থিংক ট্যাংকের স্বপ্ন দেখেছিলেন আল – শারক তারই প্রতিচ্ছবি। খানফারের স্বপ্ন আরবে কোন সীমান্ত/কাঁটাতার থাকবে না। সবাই অবাধে কথা বলবে, স্বাধীন জীবন যাপন করবে নিজেদের মাঝে ব্যবসা পরিচালনা করবে। অনেকটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মত।
অন্তত যুদ্ধে পৃষ্ঠ ফিলিস্তিনের চেয়ে আমাদের অবস্থা অনেক অনেক ভালো। তাহলে আমাদের খানফাররা কই!
- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version