অতীত গবেষকদের ‘আর্কাইভ’ জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরেও সংস্কারের ছোয়া লাগুক

মুতাসিম বিল্লাহ

বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্যর সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রাপ্ত বস্তুগত নিদর্শণকে পরবর্তী জেনারেশনের জন্য গবেষণার সুযোগ করে দিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও জাতীয় জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ দুটো প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিগত সময়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেভাবে শিক্ষা ও গবেষণায়, শিক্ষক-শিক্ষার্থীবান্ধব করা যেত, প্রাচীন, প্রত্ন ও ইতিহাস গবেষকদের আর্কাইভ হিসেবে যে ভূমিকা রাখতে পারত তা আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতায় সম্ভব হয়নি। বরং জাহাঙ্গীরনগর, কুমিল্লা ও বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় রংপুর এ প্রত্ন ও ইতিহাস চর্চায় নিয়োজিত শিক্ষার্থীরা এসব প্রতিষ্ঠানে আবেদন করারও সুযোগ পায়নি।

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর দেশের সবচেয়ে বড় জাদুঘর ও সংগ্রহশালা। এটি বাংলাদেশের ঐতিহাসিক, প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃ-তাত্ত্বিক, শিল্পকলা ও প্রাকৃতিক ইতিহাস সম্পর্কিত নিদর্শনাদি সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রদর্শন ও গবেষণার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশ শাসনামলে ১৮৫৬ সালে দি ঢাকা নিউজ পত্রিকায় প্রথম ঢাকায় একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯১৩ সালে ঢাকা জাদুঘর নামে এর যাত্রা শুরু হয়েছিল। ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নে যারা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন এইচ.ই স্টেপলটন, সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র, সৈয়দ আওলাদ হাসান, বি.কে দাস, খাজা মুহম্মদ ইউসুফ, হাকিম হাবিবুর রহমান, নলিনীকান্ত ভট্টশালী, জে.টি র্যাঙ্কিন, এ.এইচ ক্লেটন, অধ্যাপক আর.বি রামসবোথাম ও সৈয়দ মুহম্মদ তৈফুর। তবে ঢাকা জাদুঘরের উন্নয়নে নলিনীকান্ত ভট্টশালীর নাম বিশেষভাবে স্মরণীয়। তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও আগ্রহের ফলে ঢাকা জাদুঘর দেশে-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেছিল। তিনি নিজে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য পরিচালনা এবং প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে নিদর্শন সংগ্রহ করে জাদুঘরকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। নিদর্শনের শ্রেণিকরণ, ডকুমেন্টেশন, লেবেল তৈরি, প্রদর্শনী উপস্থাপনা এবং নিদর্শনের যথাযথ সংরক্ষণের ব্যবস্থাপনা, সব ক্ষেত্রেই ভট্টশালীর অবদান অনস্বীকার্য। ১৯৫১ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত জাদুঘর পরিচালনার দায়িত্ব ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর। এ সময় অবৈতনিক খন্ডকালীন কিউরেটর হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আহমদ হাসান দানী, আবু মহামেদ হবিবুল্লাহ, সিরাজুল হক, মফিজুল্লাহ কবীর প্রমুখ দায়িত্ব পালন করেন। তাঁদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছিলেন প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাস গবেষক আহমদ হাসান দানী। তাঁর ব্যক্তিগত আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় ঢাকা জাদুঘরের নিদর্শন সংগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং প্রদর্শনী কক্ষের ব্যাপক উন্নতি ঘটে।
অপরদিকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, যেটি ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ শাসনামলে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া নামে এই প্রতিষ্ঠানটি যাত্রা করে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঢাকায় এর কার্যালয় এটি  স্থাপিত হয়। ১৯৮৩ সালে বিভাগীয় পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে ঢাকায় প্রধান দপ্তরসহ ৪টি বিভাগে আঞ্চলিক অফিস প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ ছাড়া অধিদপ্তরের অধীনে ২০ টি প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর রয়েছে। এ অধিদপ্তর দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রাচীন সংস্কৃতি চিহ্নের আবিস্কারের মাধ্যমে ইতিহাস পুনরুদ্ধার এবং আবিস্কৃত স্থাপত্যিক কাঠামোর সংস্কার সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের কাজ করে থাকে। দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যখন পরিবর্তনের, সংস্কারের দাবি উঠেছে সেই মুহুর্তে এই দুটো প্রতিষ্ঠানেও সংস্কারের ছোয়া লাগুক।

একবছরের জন্য কিংবা হঠাৎ করে ইতিহাস-প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞান না থাকা আমলাদের নিয়োগ দেওয়ার পরিবর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষক ও গবেষকগণ ইতোমধ্যে ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংরক্ষণ, প্রত্নচর্চায় পঠন, পাঠনে  দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুনাম সুখ্যাতি ছড়িয়েছেন, ইতিহাস,ঐতিহ্য, প্রত্নচর্চায় নিজেদের গবেষণায় নিয়োজিত এমন মানুষদের হাতেই দায়িত্ব দেওয়া হোক জাতীয় জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যেমন সমন্বয় করে উৎখনন, জরিপ ও উৎখনন পরবর্তী ল্যাব ও গবেষণাগারে বস্তুগত নিদর্শন নিয়ে কাজ করতে পারে, যৌথভাবে গবেষণা কাজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নাল ও বই হিসেবে প্রকাশ করতে পারে, সেই উদ্যোগ নিলে তবেই আমাদের জাতীয় সম্পদের যথোপযুক্ত সংরক্ষণ ও আগামী ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য উপস্থাপন করা যাবে। তবেই এক সময়ে এই প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা ও গবেষণায় যেমন অগ্রগামী ছিলো সেই সোনালী সুদিনে ফিরতে পারবে। জাতীয় জাদুঘর ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর যেই লক্ষ্য নিয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছিলো তাঁর বাস্তবায়ন ঘটবে।
লেখক পরিচিতিঃ শিক্ষক, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।
ইমেইল- mutasim.b@cou.ac.bd

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version