ভাষা শহীদেরা কেউ মরেনি

নুর মোহাম্মদ সোহান

বাংলা ভাষার পটভূমি ২১ শে ফেব্রুয়ারি , ১৯৫২ অন্যতম স্মরণীয় দিন বাঙালি জাতির ইতিহাসে। এদিন বাঙালি জাতিসত্তার বীজ বপন করে হয়েছিল, উন্মোচিত হয়েছিল জাতীয়তা । বাংলার রাষ্ট্র ভাষার প্রশ্নে যখন উর্দুকে টেনে আনার পাঁয়তারা চলছিলো তখন জাতির সূর্য-সন্তানরা তুমুল আন্দোলনে ঢাকার রাজপথে নামে । পাকিস্তান সরকারের প্রবর্তিত ১৪৪ ধারা আইন ভঙ্গ করে বাঙালির মায়ের শেখানো মুখের ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবিতে অটল থাকেন। হানাদারের গুলিতে ঝড়ে পড়া তাজা রক্ত দিয়ে সেদিন লেখা হয়েছিল বাংলা ভাষার বর্ণ অ,আ ক,খ ।

বাংলা ভাষার বৈশ্বিক অবস্থান ও সম্মাননা : বর্তমানে বিশ্বে প্রায় ৩০ কোটি লোকের ভাষা বাংলা । ভাষার দিক দিয়ে বাংলা ভাষা পৃথিবীতে ৪র্থ । বাংলা ভাষার কথা উঠলেই বলতে হবে বাংলাদেশ এবং ভারতের বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলের কথা । বাংলাদেশে প্রতিটি মানুষের ভাষা বাংলা। আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোরও নিজস্ব ভাষা থাকা সত্ত্বেও বেশিরভাগই বাংলায় কথা বলতে জানে, বিশেষ করে আদিবাসী শিক্ষিত সম্প্রদায় । ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যবহৃত ভাষা বাংলা যার সংখ্যা প্রায় ৯.৭২ কোটি । পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ঝাড়খণ্ড, ত্রিপুরা বিহার, ওড়িশ্য, মহারাষ্ট্র, ছত্তিসগড়, উত্তর প্রদেশ ও মেঘালয় এইসব রাজ্যগুলোতে বাংলা ভাষার প্রচলন বেশি তাছাড়া প্রায় ভারতের সব অঞ্চলেই বাংলা ভাষা ব্যবহারকারীরা উপস্থিতি রয়েছে । পাকিস্তানের করাচিতে প্রায় ২১ লক্ষ মানুষের মুখের ভাষা বাংলা । আফ্রিকান দেশ সিয়েরা লিয়নে সরকারি ভাবে ঘোষিত দ্বিতীয় মাতৃভাষা বাংলা । এছাড়াও পৃথিবীর সকল দেশেই বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী রয়েছে ।

পৃথিবীতে বাঙ্গালিই একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্যে বৃষ্টির মতো রক্ত দিয়েছে, প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে অকাতরে । সেই সকল ভাষা শহীদের রক্তের সম্মাননা স্বরূপ আজ বাংলা প্রতিষ্ঠিত মাতৃভাষা । ভাষাশহিদ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে ২১ ফেব্রুয়ারি , শহীদবেদিতে শহিদের স্মরণে জমা হয় পুষ্পের সমাহার । মিলেছে আন্তর্জাতিক সম্মান, ঘোষণা করা হয়েছে ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ।

বর্তমান প্রেক্ষাপট: এতো অর্জন আর গৌরব থেকেও আজ দুঃখের সাথে বলতে হয় বাংলা ভাষা তার অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। রক্ত ঝরানোর ৭২ বছর বয়সে এসে ঝরানো রক্তের লাল রং মলিন হয়ে মুছে যাচ্ছে, হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে, জলধারায় ধুয়ে যাচ্ছে । যতটুকু আবেগ-ভালোবাসা, দরদ ও মমতা নিয়ে সেদিন ভাষার জন্য গাঢ় লাল রংঙের শোণিতে কালো মাটি রাঙ্গায়িত হয়েছিল, তার কতটুকু রং অবশিষ্ট রয়েছে ? কতটা দরদ আর মমতায় রক্ষিত হচ্ছে বাংলা ভাষা ?

বাংলা ছিলো বাঙালির হ্নদয় প্রকাশক ।বাংলাতেই মাঝি-মাল্লা,কৃষক-শ্রমিক মুটে মজুরের নাও বেয়ে গাঙ পাড় হওয়া, ফসলের মাঠে অবারিত সবুজ শস্য দেখে, বিদ্রোহে- বিপ্লবে রাজপথে – গানের টানে প্রাণে শিহরন জাগাতো। কত মধু ! কত জাদু ! বিদেশি ভাষা- সংস্কৃতির প্রভাবে পড়ে আজ বাংলা তার গুরুত্ব হারাচ্ছে, হারাচ্ছে ঐশ্বর্যমণ্ডিত দামাল ইতিহাস।কলকাতা আর বাংলাদেশ দুই জায়গাতেই এই হাওলাতি সংস্কৃতির উপস্থিতি দৃশ্যমান । ভারতে বাংলামাধ্যমের বিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার জায়গা দখল করে নিচ্ছে ইংরেজি আর হিন্দি শিক্ষার বিদ্যালয় । ইংরেজিতে বলতে পারলে তাকে বাহ! বাহ! দেওয়া হচ্ছে দুই হাতে। অথচ আমরা আমাদের জাত ভুলে যাচ্ছি । এই কলকাতাই ছিল একসময় বাংলা চর্চার আঁতুড়ঘর । এই পশ্চিমবঙ্গ থেকেই রচিত হয়েছিল বাংলা ভাষার অধিকাংশ শ্রেষ্ঠ রচনাবলি । এইখানে বসেই বাংলা ভাষায় চর্চা হয়েছিল জ্ঞান বিজ্ঞান আর সাহিত্য – সংস্কৃতির।কিন্তু আজ তার এমন দুঃখ- দৈন্য পরিস্থিতি মেনে নেওয়া বেদনাদায়ক ।তবুও ভারতের কথা মেনে নেওয়া যায় সেখানে হিন্দি ভাষার প্রভাব থাকবে সেটা স্বাভাবিক ।কিন্তু বাংলাদেশে এমন দুঃখ- দুর্বিষহের কথা কীভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে ? পশ্চিমা সংস্কৃতি্র বিকাশ বাংলাদেশে পায়ের পাতা থেকে মাথার ডগায় পৌঁছেছে । পোশাক-পরিচ্ছেদ , খাদ্যাভ্যাস, রীতিনীতি, ধ্যান- ধারণায় আমরা বাঙালিরা আজ অনুকরণের মাধ্যমে আমাদের বাঙালি সত্তাকে হারিয়ে ফেলছি । প্রশান্তির খোঁজে বাংলা গানের ধুয়া আর শোনা যায় না । রুচির আকাল পরে গেছে । এমন সব সঙ্গীত আজ আমাদের কালজয়ী বাংলা ভাষায় রচিত সঙ্গীতকে মাটি চাপা দিচ্ছে যেগুলোর বাদ্যের প্রভাবে গানের কথাই স্পষ্ট না । ভাষা প্রয়োগ আর উচ্চারণের কথায় আরো ব্যথা জেগে উঠে প্রাণে ! বাংলা ভাষা প্রকাশে প্রায় বেশিরভাগ অংশজুড়ে আছে বিদেশি শব্দের ব্যবহার । শিক্ষিত শ্রেণির মধ্যে এর মাত্রা অত্যোধিক প্রকট।বইমেলায় প্রকাশিত বই এর মলাট দেখে সত্যিই বলতে হয় এই জাতি রুচির দুর্ভিক্ষে মৃতপ্রায়। প্রচণ্ড ক্ষুধায় যা পায় তার সবই গিলে ।

আজ ক্ষোভ জমে আছে কালো মেঘের ন্যায় ঘন হয়ে শব্দের আকাশে । ভাষা শহীদেরা সেই ক্ষুব্ধ কালো মেঘের অংশ । কান্নায় বুক বিদীর্ণ করে ফেলছে কিন্তু আমরা কেউ শুনছি না সেই কান্না। বধির হয়ে শহিদবেদিতে ফুল নিবেদনে যাই শহীদ স্মরণে ! শহীদবেদির কথাগুলোও শুনতে পায় না! অনবরত ডেকে বলছে ফুল দিতে হবে না বরং ভাষাকে বাঁচাও! যেই মায়ায় পড়ে পূর্বপুরুষ জীবন দিয়েছে সেই শব্দ মায়াকে ভালোবাসো হৃদয় ধারণ করো।

আজ কলুষিত মাটি শহিদদের ধারণ করার যোগ্যতা হারাচ্ছে। তারা মুক্তি চায় অসম্মান আর দুর্দিন থেকে। সমস্বরে চেঁচিয়ে গাইছে “ পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহভরা কোলে তব মাগো, বলো কবে শীতল হবো! ভাষা শহীদেরা কেউ মরেনি , রফিক, জব্বার, শফিক, বরকত ও আলতাফ মাহমুদ সহ তারা সবাই বেঁচে আছে তবে অভিমানে আত্মগোপন করে আছে। এই অভিমান ভাষাকে অসম্মান করার অভিমান। এই অভিমান অবমুল্যায়িত রক্তের অভিমান।

চব্বিশের ভাষা শহীদ-দিবসে ভাষাকে ঘিরে চেতনা জাগ্রত হোক ,শহিদ মিনারের মতো মাথা তুলে বর্ণের ঝান্ডা উড়িয়ে ভাষা দাঁড়িয়ে থাকুক আজীবন । কৃষ্ণচূড়ার মতো টুকটুকে লাল আর বায়ান্নোর রক্তের মতো তরতরে তাজা থাকুক ভাষা, বর্ণ শব্দ । আহত শব্দ মুক্তি পাক সংকটের বন্ধন থেকে এই নব দিবসে ।বাংলা ভাষার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ুক বিশ্বব্যাপি, আলোড়িত করুক বিশ্ব ইতিহাস ।

লেখক: শিক্ষার্থী, লোক প্রশাসন বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়। 

(বিডিফিচার নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে। প্রকাশিত লেখাটির আইনগত, মতামত বা বিশ্লেষণের দায়ভার সম্পূর্ণরূপে লেখকের, কর্তৃপক্ষের নয়। লেখকের নিজস্ব মতামতের কোনো প্রকার দায়ভার কর্তৃপক্ষ নেবে না।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here