অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা মানুষের শরীরে রক্ত জমাট তৈরি করে কেন?

অনুবাদ: জুবায়ের রহমান

করোনা মহামারির প্রতিরোধে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় এবং অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্যোগে বাজারে আসে অ্যাস্ট্রাজেনেকা ভ্যাকসিন। যার গ্রহণযোগ্যতা বিশ্বের অন্যান্য ভ্যাকসিনের চাইতে অনেকাংশেই বেশি। এই ভ্যাকসিনের কারণেই পৃথিবীব্যাপী অসংখ্য মানুষের জীবন বেঁচে গিয়েছিল। তবে টিকা নেওয়া কিছু মানুষের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার অভিযোগে টিকাদান কর্মসূচি স্থগিত করেছিল কয়েকটি রাষ্ট্র। কারণ এই সময়টিতে টিকা নেওয়া প্রায় ৫০ হাজার মানুষের শরীরে রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়ার সমস্যা দেখা দিয়েছিল।

এই রক্ত জমাট বাঁধার উপসর্গটি vaccine-induced immune thrombotic thrombocytopenia (VITT) বলে পরিচিত। এই অবস্থার মানুষদের মধ্যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার প্রক্রিয়াটির সাথে কিছু ভুল হয়ে যায় এবং মানুষের শরীরে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা শরীরের প্রোটিনের সাথে লেগে থাকতে পারে।

শরীরের এসব প্রোটিনকে প্লেটলেট ফ্যাক্টর 4 (PF4) বলা হয়। আমরা জানি যে সংক্রমণের সময়, অনেক লোকের শরীরে আপনা-আপনি অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। যা রোগ প্রতিরোধের (ইমিউন) প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসাবে PF4 এ লেগে থাকে। কিন্তু এই অ্যান্টিবডিগুলি সাধারণত দুর্বলভাবে লেগে থাকে। VITT-তে যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় তা সুপারগ্লুর মতো PF4-এর সাথে লেগে থাকতে পারে।

VITT-এর অ্যান্টিবডিগুলি PF4 অণুকে একত্রে আঠালো করে, যা ‘ইমিউন কমপ্লেক্স’ নামে পরিচিত বড় কাঠামো তৈরি করে। এই জটিলতাগুলো প্লাটিলেট নামক ছোট কোষগুলির সাথে আবদ্ধ থাকে। যা রক্ত জমাট বাঁধার জন্য সক্রিয়ভাবে কাজ করে। এই প্লাটিলেটগুলো সাধারণত নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রক্তে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু একবার সক্রিয় হলে তারা সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে খুব আঠালো হয়ে যায় এবং শত শত বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ বের করে দেয়।

VITT-তে, প্লাটিলেটগুলো সক্রিয় হয়ে খুব শক্তভাবে রক্ত জমাট তৈরি করে। রক্তের জমাট বাঁধার কারণে মস্তিষ্কের চারপাশের শিরাগুলোকে প্রভাবিত করে। যা খুবই অস্বাভাবিক এবং বিরল স্থান। VITT-তে আআক্রান্ত অনেক লোকই উদ্বেগজনক মাথাব্যথার কথা জানিয়েছেন, যা মানুষকে প্রতিনিয়ত প্রভাবিত করছে।

রক্ত এইভাবে জমাট বেঁধে যাওয়ার কারণে দেহে প্লাটিলেটের সংখ্যা অনেক কমে যায়। এর ফলে কিছু রোগীদের গুরুতর রক্তপাত হয় এবং ৪ জনে ১জন রোগী মারা যায়। আবার অনেককেই জীবনভর পঙ্গু করে রাখতে সক্ষম।

প্রমাণের খুঁজে

মাত্র আড়াই বছর হলো যে গবেষকরা VITT এর রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে শুরু করেছে। কীভাবে VITT জমাট বাঁধে এবং কেন কিছু লোকের এটি হয়ে থাকে সেটি দেখতে চেষ্টা করছে। আর এটি বোঝার মাধ্যমেই চিকিৎসকরা চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্‌ঘাটন নিয়ে কাজ করা শুরু করে।

কিছু লোক কেন VITT পায় সে সম্পর্কে কিছু জেনেটিক সূত্র রয়েছে। একটি জিনের পরিবর্তন অ্যান্টিবডির অন্যান্য অংশগুলোকে VITT-এর সাথে যুক্ত করে। ইউরোপীয় বংশোদ্ভূতদের এটি বেশি দেখা যায়। ফলে তারা VITT এর উচ্চঝুঁকিতে রয়েছে। অন্যান্য আরো অনেক জিন থাকতে পারে, কিন্তু সেগুলো খুঁজে পাওয়া কঠিন। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যের কয়েকজন গবেষক VITT আক্রান্ত ২০০ টিরও বেশি রোগীর ডিএনএ সিকোয়েন্সিং করেছেন এবং খুব শীঘ্রই এটির ফলাফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

সম্প্রতি এক গবেষণায় একটি টেস্ট টিউবে ওষুধ দিয়ে এই VITT সক্রিয়করণকে ব্লক করা যায়।

একজন সুস্থ মানুষের শরীরে প্লাটিলেটগুলো PF4 এবং VITT অ্যান্টিবডিগুলোতে কীভাবে কাজ করে তা আমরা আমাদের গবেষণায় দেখতে পেয়েছি। আমরা মনে করেছিলাম যে এই অ্যান্টিবডিগুলোর কাজ করার ভিন্নতা কিছু লোকের VITT পাওয়ার কারণ। তখন আমরা আরো কাজ করি যে প্লাটিলেটগুলো আরও কাজ করার ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া এবং নিম্ন পর্যায়ের প্রতিক্রিয়া পার্থক্য বের করার চেষ্টা করেছি।

VITT এর অবাক করা আরেকটি বিষয় হলো যে কেন এত মানুষের মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বেঁধেছে। তবে মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার এই ঘটনা খুবই বিরল। এক বছরে এক মিলিয়ন মানুষের মধ্যে শুধু তিন থেকে চারজনকে এই রোগে প্রভাবিত করতে পারে। আর VITT রোগীদের ক্ষেত্রে এই ক্লট বা রক্ত জমাট বাঁধা হয় অর্ধেকের চেয়েও বেশি রোগীর।

VITT রোগীদের মস্তিষ্কে কোন কারণে রক্ত জমাট বাঁধে সে সম্পর্কে কিছু তত্ত্ব রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে রক্তপ্রবাহের গতির এবং PF4 এর আঠালোতা ও রক্তনালিতে অ্যান্টিবডি। সম্প্রতি, কানাডিয়ান বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে রোগীদের অ্যান্টিবডিগুলি PF4 এর সাথে লেগে থাকে তাদের মস্তিষ্কে জমাট বাঁধার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে এখনও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়

এই ভ্যাকসিনগুলো লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচিয়েছিল। তবে VITT এর উচ্চঝুঁকির কারণে তারা উন্নত দেশগুলিতে সুবিধার বাইরে চলে গেছে। তবে এই ভ্যাকসিনগুলি এখনও নিম্ন আয়ের দেশগুলিতে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এগুলো অত্যন্ত কার্যকর, সস্তা, এবং mRNA ভ্যাকসিনগুলোর তুলনায় সঞ্চয় করা সহজ। এছাড়াও পরিবহণ করা সহজ Pfizer-BioNTech ও Moderna jabs এর মতো ভ্যাকসিনগুলো৷

VITT-এর প্রতি যখন গবেষকদের জানাশোনা বাড়লো, তখন যাদের রক্ত জমাট বাঁধে তাদের দেখতে নিজেরা আরো বেশিই প্ররোচিত হয়ে উঠলো। লক্ষণীয় বিষয় হলো যে রক্ত জমাট, কম প্লাটিলেট ও VITT-এর মতো অ্যান্টিবডি সহ আরও বেশি সংখ্যক রোগী পাওয়া যাচ্ছে। যা টিকা দেওয়ার সাথে সম্পর্কিত নয়।

সম্প্রতি, টিকা দেওয়ার পরিবর্তে অ্যাডেনোভাইরাস সংক্রমণের পরে দুটি রোগীর মধ্যে একটি VITT-এর মতো সিনড্রোম রিপোর্ট করা হয়েছিল। এই অ্যান্টিবডিগুলির জন্য পরীক্ষা করা সম্ভবত ব্যাখ্যাতীতভাবে রক্ত জমাট রোগীদের জন্য নিয়মিত হয়ে উঠবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যে একটি নতুন মহামারি নিয়ে আমাদের ভাবা প্রয়োজন যা মহামারি করোনার চাইতেও আরো বেশি বিপদজ্জনক হয়ে উঠবে। আর যারা এতে আক্রান্ত হবে তাদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আতঙ্ক ও বিশৃঙ্খলা থাকবে। VITT এর ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমাদের মরিয়াভাবে অ্যাডেনো ভাইরাল ভ্যাকসিনের প্রয়োজন হবে। তাই VITT ভিতরে এবং বাইরে বোঝা গুরুত্বপূর্ণ।

 

(দ্য কনভারসেশন থেকে অনুবাদিত। মূল লেখক: রিচার্ড বুকা ও সামান্থা মন্টাগু, গবেষক ও শিক্ষক: বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়)

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version