আত্মহত্যা প্রতিরোধে শিক্ষার্থীদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত করা প্রয়োজন

মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যে একটা রোগ, সেটা এখনো সবার কাছে পরিচিত করতে পারিনি। এজন্য শৈশব থেকেই শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। স্কুল-কলেজ থেকে যদি শিক্ষার্থীরা মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জেনে আসে, তাহলে তারা কিন্তু ছোট থেকেই মানসিকভাবে অনেক স্ট্রং হবে। তখন সে বুঝতে পারবে যে, সে কখন মানসিক সমস্যায় আছে।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সালমা আক্তার উর্মি। পড়াশোনা করেছেন একই বিভাগে। বিভাগের শিক্ষার্থী থাকাকালীন সময়ে অ্যাকাডেমিক কাজের অংশ হিসেবে গবেষণা করেছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা নিয়ে। গবেষণার বিষয় ‘Risk factors of suicide among public university students of Bangladesh: A qualitative exploration’। প্রকাশিত হয়েছে ‘Heliyon’ জার্নালে। গবেষণার সার্বিক বিষয়বস্তু নিয়ে কথা বলেছেন জুবায়ের রহমান।

বিডিফিচার: আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?

সালমা আক্তার উর্মি: আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?

বিডিফিচার: আমি ভালো আছি। আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা নিয়ে গবেষণা করছেন। এই বিষয় নিয়ে গবেষণার আগ্রহ কেন তৈরি হয়েছিল?

সালমা আক্তার উর্মি: ২০১৯ সালে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নকালীন সময়ে অ্যাকাডেমিক কাজের অংশ হিসেবে আমি থিসিস পাই। তখন সুপারভাইজার আমাকে রিসেন্ট ইস্যু নিয়ে কাজ করতে বললে দ্য ডেইলি স্টারের একটা সম্পাদকীয় আমার চোখে পড়ে। যার শিরোনাম ছিল ‘Alarming suicide rate at public universities’। সেখানে ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মহত্যার চিত্র দেখানো হয়েছিল এবং এক বছরে ১৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। এই সম্পাদকীয় দেখার পরপরই আমার আগ্রহ জাগে আত্মহত্যা নিয়ে কাজ করার। পাশাপাশি আমি অনুভব করি যে, এই বিষয় নিয়ে গবেষণা করলে আমি জানতে পারব কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করে এবং এর সমাধানের উপায় কি? মূলত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সচেতন করার উদ্দেশ্যেই আমার এই গবেষণা।

বিডিফিচার: সাম্প্রতিক সময়ে কেন আত্মহত্যা বেড়েছে?

সালমা আক্তার উর্মি: সাম্প্রতিক সময়ে বেড়েছে বিষয়টা এমন না। আমরা যখন স্কুলে পড়তাম, ২০০৫-০৬ এর দিকেও শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করত। কিন্তু আমরা এতবেশি গণমাধ্যম কিংবা স্যোশাল মিডিয়ায় যুক্ত ছিলাম না। ফলে আত্মহত্যার নিউজগুলো আমরা সেভাবে জানতে পারতাম না। তবে এটা সত্য যে আগের চেয়ে আত্মহত্যার হার অনেক বেড়েছে। এর অনেকগুলো কারণের মধ্যে নিজেকে সবসময় সেরাদের সেরা কাতারে দেখতে না পারা, জিপিএ ৫ না পাওয়ার মতো কিছু কারণ রয়েছে। যার জন্য দায়ী আমাদের পরিবার ও সমাজ কাঠামো। আগেকার সময়ে আমরা সবাই আড্ডা দিতাম, খেলাধুলা করতাম এবং সবার সাথে সবার সরাসরি কথাবার্তা হতো। আর এখন আমরা মোবাইলে এতবেশি ব্যস্ত যে একসাথে বসে থাকলেও একজন অপরজনের সাথে কথা বলা হয় না। যার ফলে আমরা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি। আত্মহত্যার কথা বলতে গিয়ে সমাজবিজ্ঞানী এমিল ডুর্খেইমও বিচ্ছিন্নতার কথা উল্লেখ করেছেন। আর এ কারণেই আত্মহত্যার হার অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিডিফিচার: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কেন আত্মহত্যা করে?

সালমা আক্তার উর্মি: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার মূল কারণগুলো হচ্ছে হতাশা, আশাহীনতা ও উদ্বিগ্নতা। আবার পরিবার ও সমাজের একটা আলাদা চাপ থাকে যে, ‘ও পারলে তুমি কেনো পারবে না?’। আর প্রেমে ব্যর্থতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা হয়ে থাকে। এছাড়াও শিক্ষার্থীদের অর্থনৈতিক দুষ্প্রাপ্যতা, সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পারা, পড়াশোনায় বিপর্যয়. সমাজের সহযোগিতা না থাকা, বুলিং, র‌্যাগিং, মাদকাসক্ত, নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে না পারা ও কাউন্সেলিং সেন্টারের অভাব ইত্যাদি কারণে আত্মহত্যা করে থাকে।

বিডিফিচার: আত্মহত্যা কাউকে প্ররোচিত করে কি?

সালমা আক্তার উর্মি: হ্যাঁ, অবশ্যই করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি কেইস আমি আমার গবেষণায় পেয়েছিলাম। গবেষণা ইথিকসের কারণে আমি নাম নিচ্ছি না। ঐ স্টুডেন্ট মারা যাওয়ার পর ওর ব্যাচের অন্য শিক্ষার্থীরা কোনো সমস্যায় পড়লেই একে অপরের সাথে বলাবলি করত ‘ওতো মরে গিয়ে বেঁচে গেছে, আমিও মরে যাই! সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ মানে আত্মহত্যা করলেই সকল সমস্যার সমাধান।

আবার নাটক-সিনেমাতে আত্মহত্যা দেখে অন্যরা প্রভাবিত হয়। অনেকে এরকম চিন্তা করে যে, ‘আত্মহত্যা করলেই আমি সেলিব্রিটি হয়ে যাব। সবাই আমাকে চিনবে।’ মোদ্দাকথা যেকোনো ছোঁয়াচে রোগের মতো সুইসাইডও একটা সংক্রামক ব্যাধি।

বিডিফিচার: আত্মহত্যার ধরণগুলি কেমন হয়ে থাকে?

সালমা আক্তার উর্মি: আমি আমার গবেষণায় আত্মহত্যার ধরণ নিয়ে কোনো কাজ করিনি। তবে বিষ খেয়ে ফেলা, গলায় দড়ি দেওয়া, উঁচু দালান থেকে লাফ দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। তবে মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ফেলা, বিষ খেয়ে ফেলার মাধ্যমে নিজেকে শেষ করার চেষ্টা করে থাকে। অন্যদিকে ছেলেরা আত্মঘাতী কাজের মাধ্যমে আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকে। আমি আমার গবেষণায় দেখেছি ছাত্রীরা এটেম্প নেয় বেশি, কিন্তু সুইসাইড করে বেশি ছাত্ররা। এটা শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইস্যু না, সাহিত্য পর্যালোচনাতে আমরা এটা দেখেছি।

বিডিফিচার: কোন সময়ে এসে শিক্ষার্থীরা বেশি আত্মহত্যা করে থাকে?

সালমা আক্তার উর্মি: এটা আসলে আলাদা করার উপায় নাই। সকল বর্ষের শিক্ষার্থীরাই করতে পারে। তবে আমি আপনাকে এটা বলতে পারি যে, কোন বর্ষের শিক্ষার্থী কখন আত্মহত্যা করে থাকে।

প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা মূলত নতুন জায়গায় এসে অনেকেই নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না। অনেকেই অর্থনৈতিকভাবে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন। আবার ইমোশনাল কারণেও আত্মহত্যা করতে পারে। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে এসে শিক্ষার্থীদের হতাশা অনেক বেশি বেড়ে যায়। আমি আমার গবেষণায় মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের এক শিক্ষার্থীর কথা জানি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিল। ইংরেজিতে সে ভালো লিখতে ও বলতে পারত না। কিন্তু পরীক্ষার খাতায় ইংরেজি লিখা বাধ্যতামূলক ছিল। ফলে রেজাল্ট খারাপ হওয়ার কারণে সে হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছিল। আরেকজনকে পেয়েছি শুধু চাকরি না পাওয়ার কারণে আত্মহত্যা করেছে।

বিডিফিচার: আত্মহত্যার প্রতিরোধ কিংবা সমাধানের উপায় কি?

সালমা আক্তার উর্মি: আমরা চাইলেই আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে পারি। কিন্তু আমাদের একটা বড় সমস্যা হলো মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা যে একটা রোগ, সেটা এখনো আমরা সবার কাছে পরিচিত করতে পারিনি। এজন্য শৈশব থেকেই শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতন করে তোলা প্রয়োজন। স্কুল-কলেজ থেকে যদি শিক্ষার্থীরা মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে জেনে আসে, তাহলে তারা কিন্তু ছোট থেকেই মানসিকভাবে অনেক স্ট্রং হবে। তখন সে বুঝতে পারবে যে, সে কখন মানসিক সমস্যায় আছে। কারণ অনেকেই বুঝতেই পারে না যে কেউ মানসিক সমস্যায় আছে।

এই সমস্যা সমাধান ক্ষেত্রে সহশিক্ষা কার্যক্রম একটি ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। সহশিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত হলে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা দূর হয়ে যাবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে সভা, সেমিনারের আয়োজন করা, মেন্টাল হেলথ নিয়ে ওয়ার্কশপ করলে শিক্ষার্থীরা মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন হবে। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কমিউনিটি লেভেলে গিয়ে অভিভাবকদের সচেতনতার মাধ্যমে এ সমস্যা কমিয়ে নিয়ে আসতে পারে। মেন্টাল হেলথ প্রফেশনাল, পলিসি মেকার, রিসার্চার, অ্যাকাডেমিশিয়ান যারা আছে তাদের উচিত মেন্টাল হেলথকে প্রমোট করা। এছাড়াও মেন্টাল হেলথ নিয়ে যে গবেষণা হয়ে থাকে, সে কাজগুলো গণমাধ্যমে উঠে আসা উচিত। অন্যথায় গবেষণার ফলাফল মানুষজন না জানলে তাদের মধ্যে সচেতনতাও আসবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের উচিত অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও লোনের ব্যবস্থা করা, আত্মহত্যার তথ্য সংরক্ষণ, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার-প্রসার, নাটিকা ইত্যাদির মাধ্যমে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি তুলে ধরা।

বিডিফিচার: আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয়, পরিবার, শিক্ষক ও সহপাঠীরা কেমন ভূমিকা রাখতে পারে?

সালমা আক্তার উর্মি: আমি পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার গবেষণা কাজ করেছি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন আমি দেখেছি যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে আর কোথাও কাউন্সেলিং সেন্টার নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩টি কাউন্সেলিং সেন্টার আছে। বেশিরভাগ বাইরে থেকে আসা লোকজন সেবা নিতে আসে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তেমন একটা আসে না। কারণ সবাই মনে করে আমাকে নিয়ে অন্যরা কি ভাববে। প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কাউন্সেলিং সেন্টার থাকা উচিত। একইভাবে আমাদের পরিবারের উচিত তাদের সন্তানদের দিকে মনোযোগী হয়ে উঠা, সন্তানদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া।

আমাদের শিক্ষকদেরও একটা ভূমিকা থাকা উচিত। প্রায় সময়ই ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিত। কারো কোনো হতাশাজনক ফেসবুক পোস্ট, একটানা ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা উচিত। আমি যখন কাউকে দেখব ডিপ্রেসড, তখন তার সমস্যা জানতে চাইব। তবে সত্যি কথা হচ্ছে যারা ডিপ্রেসড তারা তাদের মনের কথা অন্যদের সাথে শেয়ার করতে চায়। এসময় সহপাঠীরা অবশ্যই তার পাশে দাঁড়াবে হতাশার সময়। কারো হতাশা নিয়ে মজা করা যাবে না।

বিডিফিচার: আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে কাউন্সেলিং সেন্টার কি ভূমিকা রাখতে পারে।

সালমা আক্তার উর্মি: কাউন্সেলিং সেন্টার প্রথমত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচার করানো উচিত যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও একটি রোগ। এটা অনেকেই জানে না বলে, অনেকেই মানসিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও কারো সাথে কনসাল্ট করে না। কারণ সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গেলে সবাই তাকে মানসিক রোগী ভাববে।

আবার আমাদের শারীরিক সমস্যা হলে যেমন কিছু উপসর্গ থাকে, আত্মহত্যারও কিছু উপসর্গ রয়েছে। যদি একে অপরের সাথে শেয়ারিং হয় ও ঠিকঠাক যোগাযোগ হয় তাহলে আমাদের এখানে আত্মহত্যার হার অনেকটাই কমে আসবে।

বিডিফিচার: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

সালমা আক্তার উর্মি: আপনাকে ও বিডিফিচারকে ধন্যবাদ।

- Advertisement -

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Exit mobile version